হার্টের ব্লক দূরীকরণের চিকিৎসায় করোনারি এনজিওপ্লাস্টি বা রিং পরানো এবং বাইপাস সার্জারি আমাদের দেশে এখন খুব সাধারণ বিষয়। তবে হার্টের প্রধান রক্তনালিতে ব্লক, রক্তনালির গোড়ায় ব্লক, ৯৯/১০০ শতাংশ ব্লক বা কোনো একটি ধমনিতে লম্বা বিপজ্জনক ব্লক থাকলে বাইপাস সার্জারিই চূড়ান্ত চিকিৎসা। লিখেছেন ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল, ঢাকার কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. লোকমান হোসেন
শরীরের সর্বত্র রক্ত সরবরাহের মাধ্যমে অক্সিজেন ও পুষ্টির জোগান দেয় হৃপিণ্ড। হৃপিণ্ডের নিজেরও পুষ্টির যতটুকু প্রয়োজন তা আসে অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু ধমনির সাহায্যে। কোনো কারণে যদি এসব ধমনি বা করোনারি আর্টারি সরু হয়ে যায় বা বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে করোনারি আর্টারির স্টেনোসিস হয়েছে বা ব্লক হয়েছে বলা হয়। সাধারণত ধমনির গায়ে চর্বি জমে তা ক্রমেই সরু হতে থাকে এবং তা ৫০ শতাংশের বেশি হয়ে গেলে সে ক্ষেত্রে হৃপিণ্ডের রক্তপ্রবাহ মাত্রাতিরিক্ত কমে যেতে থাকে এবং রোগী অল্প পরিশ্রমেই বুকে ব্যথা বা শ্বাসকষ্ট অনুভব করতে পারেন।
লক্ষণ
► বুকের বাঁ দিকে প্রচণ্ড ব্যথা ছাড়াও তীব্র চাপ অনুভব হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যথা বা চাপ কোনোটিই ৩০ সেকেন্ডের কম স্থায়ী হয় না।
► ব্যথার তীব্রতা বুকে বেশি থাকলেও এটা বুক থেকে গলা, মাড়ি, বাঁ হাত ও আশপাশে ছড়িয়ে সামগ্রিক তীব্রতাকে আরো বাড়িয়ে দেয়।
► দীর্ঘদিনের ডায়াবেটিক রোগীর ক্ষেত্রে ব্যথা বা অন্যান্য উপসর্গ না-ও থাকতে পারে। তাঁরা সরাসরি বড় ধরনের হার্ট অ্যাটাক নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।
► অন্যান্য যে কারণ এ বিষয়টিকে আরো ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে তা হলো—ধূমপান, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে উচ্চ কোলেস্টেরল বা চর্বি, বংশগত রোগের ইতিহাস, স্থূলতা, মানসিক দুশ্চিন্তা, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, বার্ধক্য, কিডনি রোগ ইত্যাদি।
পরীক্ষা ও চিকিৎসা
হৃপিণ্ডের রোগ নির্ণয়ের জন্য প্রাথমিকভাবে ইসিজি, ইটিটি, ইকো-কার্ডিওগ্রাম করা গেলেও রোগীর হার্টে ব্লক হয়েছে কি না বা হলেও কত শতাংশ এবং তা কী পর্যায়ে কোন অবস্থানে আছে, তা সঠিকভাবে নির্ণয়ের জন্য করোনারি এনজিওগ্রাম করা হয়ে থাকে। এর মাধ্যমে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা সিদ্ধান্তে আসতে পারেন যে রোগীর স্টেন্ট বসানো বা রিং পরানো সম্ভব কি না। সাধারণত যদি দেখা যায় ব্লকের সংখ্যা তিনের কম (অনেক সময় তিনটিও করা হয়), রোগীর অন্যান্য ঝুঁকি সহনীয় পর্যায়ে থাকলে সেখানে এনজিওপ্লাস্টি বা প্রচলিত ভাষায় রিং পরানো হয়ে থাকে। যদিও সব রোগীর ক্ষেত্রে এসব বিষয় সমান বা একই না-ও হতে পারে।
যখন দরকার বাইপাস সার্জারি
এনজিওপ্লাস্টি পদ্ধতিতে রক্তনালির মধ্যের চর্বি জমে সরু হয়ে যাওয়া পথ প্রশস্ত করা হয়। কিন্তু বাইপাস সার্জারির সিদ্ধান্তটা তখনই আসে যখন প্রধান রক্তনালিতে ব্লক, রক্তনালির গোড়ায় ব্লক, ৯৯/১০০ শতাংশ ব্লক বা কোনো একটি ধমনিতে লম্বা বিপজ্জনক ব্লক থাকে। অনেক সময় দেখা যায় সে স্টেন্ট/রিং পরানো হয়েছিল, তার পরও আবার বুকে ব্যথা শুরু হয়েছে। শুরু হওয়ার পরও আবার এনজিওগ্রাম করে দেখা গেল আগের একই ধমনিতে বা নতুন আরো একটিতে আবার ব্লক হয়েছে। পূর্ববর্তী কারণগুলো ছাড়াও এ ক্ষেত্রে রিং পরানো পরবর্তী সময়ে কিছু নিয়মকানুন না মেনে চলা, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, যথাযথ ওষুধ না খাওয়াকে দায়ী করা হয়ে থাকে। বাইপাস সার্জারিই এখন এর চূড়ান্ত চিকিৎসা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কারণ এতে রোগীর স্থায়ী রোগমুক্তি ঘটার সম্ভাব্যতা অনেক বেশি থাকে।
আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই
সার্জারি-পরবর্তী বেশ কিছু ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও করোনারি আর্টারি বাইপাস গ্রাফটিং, যা বাইপাস সার্জারি নামে পরিচিত, হৃপিণ্ডের ধমনির ব্লকের এটি একটি উত্তম চিকিৎসা। অযথা এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এই চিকিৎসার প্রধান উদ্দেশ্য হলো রক্তনালি বন্ধ হওয়ার কারণে হার্টের যে অংশে রক্ত চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে অথবা একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে, সেই অংশে রক্তের সরবরাহ নিশ্চিত করা। রক্ত প্রবাহিত করার জন্য একটি নতুন পথ (বাইপাস) তৈরি করা হয় পা, বুক বা কবজি থেকে ধমনি বা শিরার একটি সুস্থ টুকরা প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে।
বর্তমানে অবশ্য আধুনিক বিটিং হার্ট বাইপাস সার্জারি করা হচ্ছে, যেখানে হৃপিণ্ড চালু রেখে অত্যাধুনিক যন্ত্র ‘অক্টোপাস’-এর সাহায্যে হৃপিণ্ডের ছন্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গ্রাফটিং বা ধমনির একটি সুস্থ টুকরা প্রতিস্থাপন করা হয়। এ ক্ষেত্রে দক্ষ সার্জিক্যাল টিমের সাহায্যে বুকের ভেতরের দুই পাশের শিরা ব্যবহৃত হলে দীর্ঘমেয়াদি সুফল অনেকটা নিশ্চিত হয়। সব কিছু ভালো থাকলে দুই-তিন ঘণ্টার মধ্যেই এই সার্জারি সম্পন্ন হয় এবং দেড় থেকে দুই মাসের মধ্যেই বেশির ভাগ রোগী সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সক্ষম হয়। এ পদ্ধতির পর আবার ধমনি বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা বেশ কম। যদি আবার ব্লক ধরা পড়ে, তবে ফের সার্জারি করার সুযোগ থাকে। রোগীর অবস্থা অনুকূলে থাকলে প্রয়োজনে দুই-তিনবার বাইপাস সার্জারি করানো যেতে পারে।
সার্জারি-পরবর্তী করণীয়
সার্জারির পর রোগ প্রতিরোধের জন্য রোগীভেদে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কিছু ওষুধ খেয়ে যেতে হয় এবং কিছু সাধারণ বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয়। এর মধ্যে ধূমপান পরিহার, স্বাস্থ্যসম্মত চর্বিমুক্ত খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, শারীরিক পরিশ্রম, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ অন্যতম। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো—যেসব নিয়মকানুন সার্জারি-পরবর্তী সময়ে মেনে চলার জন্য বলা হয়, তা যদি আমরা আমাদের নিয়মিত জীবনের অংশ করে নিতে পারি, তবেই আমরা পারব নিজ হৃপিণ্ডকে সুস্থ রাখতে।
রোগীদের জন্য পরামর্শ
► অপারেশন পরবর্তী সময়ে সার্জনের পরামর্শ অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি পান করতে হবে, অতিরিক্ত পানি বা তরলজাতীয় খাদ্য গ্রহণ করা যাবে না।
► পরামর্শপত্র অনুযায়ী অবশ্যই নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হবে।
► অপারেশনের তিন-চার দিন পর থেকে হাঁটতে পারবেন। একবারে বেশি হাঁটা যাবে না, ক্লান্ত হওয়ার আগেই বিশ্রাম নিন। আহারের পরপরই হাঁটাহাঁটি করা যাবে না।
► এক সপ্তাহ পর পর হাঁটার সময় বাড়াবেন। অপারেশনের ছয় সপ্তাহ পর অন্য কোনো অসুবিধা না থাকলে দিনে ৩০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা হাঁটার চেষ্টা করুন। ক্লান্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে বিশ্রাম নিন, ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভাঙার চেষ্টা করতে পারেন।
► বেশি পরিশ্রম পরিহার করুন, টিউবওয়েল চাপা যাবে না, তিন কিলোগ্রামের বেশি ওজন বহন করা থেকে বিরত থাকুন। সংসারের হালকা কাজ করা যেতে পারে। অপারেশন পরবর্তী সময়ে প্রথম ছয় থেকে আট সপ্তাহ এই নিয়ম মেনে চলতে হবে। এরপর ভারী কাজ করতে বাধা নেই।
► ওজন নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। ধূমপান, জর্দা, তামাক পাতা, গুলজাতীয় পদার্থ চিরতরে পরিহার করুন।
► বুকে চাপ বা ব্যথা অনুভব করলে অথবা শ্বাসকষ্ট হলে দ্রুত জিহ্বার নিচে জিটিএন স্প্রে ব্যবহার করুন এবং সঙ্গে সঙ্গে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
খাদ্য নির্দেশনা
বাইপাস করা রোগীদের খাদ্যতালিকা করোনারি রোগীদের খাদ্যতালিকার অনুরূপ।
পরিহার করতে হবে : কোলেস্টেরলসমৃদ্ধ ও সম্পৃক্ত চর্বিযুক্ত খাবার, যেমন—ডিমের কুসুম, কলিজা, মাছের ডিম, খাসি বা গরুর চর্বিযুক্ত মাংস, হাঁস-মুরগির চামড়া, হাড়ের মজ্জা, ঘি, মাখন, ডালডা, মার্জারিন, গলদা চিংড়ি, নারিকেল এবং উপরোক্ত উপকরণ দিয়ে তৈরি খাবার।
ফাস্ট ফুড যেমন—বার্গার, স্যান্ডউইচ, কেক, পুডিং, আইসক্রিম, বোতলজাত কোমলপানীয় ইত্যাদি।
বেশি করে খেতে হবে : আঁশযুক্ত খাবার, যেমন সব রকমের শাক, সব রকমের সবজি (বিশেষ করে খোসাসহ সবজি যেমন—ঢেঁড়স, বরবটি, শিম, কচুর লতি ইত্যাদি), সব রকমের ডাল, সব ধরনের ফল বিশেষ করে টকজাতীয় ফল। সব রকমের সমুদ্রের মাছ, ছোট মাছ, মাছের তেল। সব রকমের উদ্ভিজ্জ তেল, যেমন কর্ন অয়েল, সানফ্লাওয়ার অয়েল, সয়াবিন অয়েল (পাম বা নারিকেল তেল নয়)।
হিসাব করে খেতে হবে : শর্করাজাতীয় খাবার যেমন—ভাত, রুটি, আলু, চিনি ইত্যাদি। মিষ্টি ফল যেমন—পাকা আম, পাকা কলা, পাকা পেঁপে ইত্যাদি। দুধ ও দুধের তৈরি খাবার।
ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত রোগীরা তাঁদের জন্য খাদ্যতালিকা তৈরি করে নিতে পারেন। রক্তে সুগার বেড়ে যায় এমন যেকোনো খাবার হৃদরোগের জন্যও পরিহার করা দরকার।
Discussion about this post