হার্টবিট ডেস্ক
থাইরয়েড কি?
থাইরয়েড হল আমাদের একটি গ্রন্থি যা আমাদের গলার সামনের দিকে অবস্থিত। এই গ্রন্থি থেকে কিছু প্রয়োজনীয়হরমোন নিঃসৃত হয়। এই হরমোন আমাদের বিপাক সহ আরো বিভিন্ন কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই হরমোন তৈরির জন্য এই গ্রন্থিটির প্রয়োজনীয় পরমাণে আয়োডিনের দরকার হয়। উক্ত হরমোন আমাদের বিপাক ক্রিয়া সহ বিভিন্ন শারীরিক এবং মানসিক বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
থাইরয়েড গ্রন্থি সাধারণত দুই ধরণের হরমোন নিঃসরণ করে।
- ট্রাই-আয়োডোথাইরোনিন(T3)
- থাইরক্সিন(T4)
বাচ্চাদের ক্ষেত্রে জন্মের সময় এই গ্রন্থি ঠিকভাবে তৈরি না হলে কিংবা প্রয়োজনমত হরমোন তৈরি করতে না পারলে বাচ্চাদের শারীরিক এবং মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
আমাদের শরীরে যতটুকু হরমোন প্রয়োজন তার চেয়ে কম কিংবা বেশি পরিমাণে এই হরমোন তৈরি হলে তখন নানা রকম সমস্যা দেখা দেয়। প্রয়োজনের তুলনায় কম পরিমাণে এই হরমোন তৈরি হলে হাইপোথাইরয়ডিজম হতে পারে। আবার প্রয়োজনের তুলনায় বেশি পরিমাণে এই হরমোন উৎপন্ন হলে হাইপারথাইরয়ডিজম হতে পারে। উভয়ই আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
এছাড়াও উক্ত গ্রন্থিতে আরো বিভিন্ন রকমের রোগ হতে পারে। সাধারণত বেশি হয় এমন কিছু রোগ নিয়ে আলোচনা করা যাকঃ
- হাইপোথাইরয়ডিজম(Hypothyroidism)
- হাইপারথাইরয়ডিজম(Hyperthyroidism)
- গয়েটার(Goiter)
- নডিউল(Nodule)
- থাইরয়েড ক্যান্সার(Thyroid Cancer)
- গ্রেভস ডিজিজ(Graves’ disease)
হাইপোথাইরয়ডিজম(Hypothyroidism ) ঃ
থাইরয়েড গ্রন্থি যদি প্রয়োজনের তুলনায় কম হরমোন উৎপাদন করে তখন হাইপোথাইরয়ডিজম হবার সম্ভাবনা আছে। যদিও অনেক সময় এর চোখে পড়ার মত লক্ষণ দেখা যায়না, যার ফলে অনেকে বুঝতেই পারেন না তারা হাইপোথাইরয়ডিজম এ আক্রান্ত।
তবে হাইপোথাইরয়ডিজম হলে সাধারণত যে লক্ষণগুলো দেখা যায় তা হলঃ
- ক্লান্তি কিংবা অবসাদ অনুভব করা
- কোনো কিছুতে মনোযোগ দিতে না পারা।
- শুষ্ক ত্বক
- কোষ্ঠকাঠিন্য
- অল্পতেই শীত শীত লাগবে
- পেশী এবং বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যাথা অনুভূত হবে।
- বিষণ্ণতা থাকবে
- মহিলাদের ক্ষেত্রে ঋতুস্রাবের সময় অতিরিক্ত পরিমাণ রক্তক্ষরণ হতে পারে।
- পালস রেট কম থাকতে পারে স্বাভাবিক এর তুলনায়।
হাইপারথাইরয়ডিজম(Hyperthyroidism ) ঃ
এক্ষেত্রে হাইপারথাইরয়ডিজম এর উল্টো ঘটনা ঘটে। থাইরয়েড গ্রন্থি প্রয়োজনের তুলনায় বেশি হরমোন উৎপাদন করলে হাইপারথাইরয়ডিজম হবার সম্ভাবনা থাকে।
থাইরয়েড গ্রন্থিকে নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্রন্থি নামক এক গ্রন্থি। মস্তিষ্কের এই পিটুইটারি গ্রন্থি কে আবার নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস নামক অংশ। এই হাইপোথ্যালামাস থাইরয়েড রিলিজিং হরমোন(TRH) নামক এক হরমোন নির্গত করে। এই TRH হরমোন এর কাজ হল পিটুইটারি গ্রন্থি কে থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন(TSH) নামক এক হরমোন নির্গত করার জন্য সংকেত পাঠানো। এই TSH হরমোন উক্ত গ্রন্থি কে থাইরয়েড হরমোন নির্গত করার জন্য সংকেত পাঠায়। বোঝা গেল তাহলে এই হরমোন উৎপাদন এর জন্য শুধুমাত্র থাইরয়েড গ্রন্থি দায়ী নয়। হাইপোথ্যালামাস, পিটুইটারি গ্রন্থি এবং থাইরয়েড গ্রন্থির মিলিত প্রচেষ্টায় হরমোন নির্গমণ কাজ সম্পন্ন হয়।
এখন উক্ত ৩ টি গ্রন্থির যে কোনো একটি বা একাধিক গ্রন্থি যদি প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কাজ করে ফেলে তখন ফলাফল হিসেবে যতটুকু হরমোন দরকার তার চেয়ে বেশি পরিমাণ হরমোন উৎপন্ন হয়। আর তখনই বাঁধে সমস্যা। যেটা হাইপারথাইরয়ডিজম নামে পরিচিত।
হাইপারথাইরয়ডিজম হলে সাধারণত যে লক্ষণগুলো দেখা যায়ঃ
- অতিরিক্ত ঘাম
- গরম সহ্য না করতে পারা
- হজমে সমস্যা
- দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ বেড়ে যাওয়া।
- অস্থিরতা অনুভব করা।
- ওজন কমে যাওয়া
- পালস রেট বেড়ে যাওয়া
- ঠিকমত ঘুম না হওয়া
- চুল পাতলা এবং ভঙ্গুর হয়ে যাওয়া
- ত্বক পাতলা হয়ে যাওয়া
- মহিলাদের ক্ষেত্রে ঋতুস্রাব অনিয়মত কিংবা খুব অল্প পরিমাণে হওয়া।
- বয়স্ক রোগীদের ক্ষেত্রে হৃদস্পন্দন বেড়ে যেতে পারে। খুব খারাপ অবস্থা হলে এবং হাইপারথাইরয়ডিজম এর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না নেয়া হলে থাইরয়েড স্টর্ম(thyroid storm) হতে পারে। এতে রোগীর রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে, জ্বর আসতে পারে এবং হৃদস্পন্দন বন্ধ ও হয়ে যেতে পারে।
গয়েটার(Goitar) ঃ
এছাড়াও থাইরয়েড গ্রন্থিটিই বড় হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে একে গয়েটার(Goiter) বা গলগন্ড বলা হয়ে থাকে। যেহেতু গ্রন্থিটি হরমোন তৈরির জন্য আয়োডিন এর প্রয়োজন পড়ে। সেহেতু আয়োডিনের অভাব হলে গ্রন্থিটি হরমোন তৈরি করতে পারেনা ঠিকভাবে। তবুও এটি চেষ্টা করে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় হরমোন তৈরি করতে। ফলস্বরূপ এটি নিজে বড় হয়ে যায় শরীরের হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে। এবং একটা সময় এটি আর পারেনা সেই স্বাভাবিক মাত্রায় হরমোন তৈরি করতে। ফলে হরমোন এর পরিমাণ কমে যায় প্রয়োজনের তুলনায়। এবং ফলাফল হিসেবে উক্ত ব্যক্তি হাইপোথাইরয়ডিজম এ আক্রান্ত হয়। এজন্য যেসব শিশু বা মানুষ আয়োডিন এর স্বল্পতায় ভুগে তাদের এই রোগ হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তবে বর্তমানে লবণের সাথে আয়োডিন গ্রহণের ফলে এই রোগের প্রাদুর্ভাব অনেকাংশেই কমে এসেছে।
নডিউল(Nodule) ঃ
এছাড়া এই গ্রন্থিতে টিউমার ও হতে পারে। যাকে নডিউল(Nodule) বলে। এক্ষেত্রে এই টিউমার সংখ্যায় এক বা একাধিক হতে পারে। এবং বিভিন্ন আকারের হতে পারে। তবে টিউমার হলেই সবক্ষেত্রে ক্যান্সার হয়না। তবে অবস্থা বেশি খারাপ হলে এবং কোনো চিকিৎসা না নেয়া হলে এটি ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। যাকে বলা হয় থাইরয়েড ক্যান্সার।
রোগ সনাক্তকরণঃ
থাইরয়েড এর বিভিন্ন রোগ সনাক্তকরণে সাধারণত নিচের পরীক্ষাগুলো করা হয়ঃ
রক্ত পরীক্ষাঃ
রক্তের বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে হরমোনের মাত্রা পরীক্ষা করা যায়। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে সাধারণত নিচের টেস্টগুলো কতা হয়ঃ
Thyroid stimulating hormone(TSH): এই পরীক্ষায় রক্তে TSH এর মাত্রা পরীক্ষা করা হয়। রক্তে TSH এর মাত্রা কম হলে বুঝতে হবে হাইপারথাইরয়ডিজমে রোগী আক্রান্ত। আর বেশি হলে হাইপোথাইরয়ডিজমে আক্রান্ত।
Thyroxine hormone(T4): রক্তে উচ্চমাত্রার T4 এর উপস্থিতির অর্থ হাইপারথাইরয়ডিজম আর নিম্নমাত্রার T4 এর উপস্থিতির অর্থ হাইপোরথাইরয়ডিজম।
Tri-iodothyronine hormone(T3): রক্তে উচ্চমাত্রার T3 এর উপস্থিতির অর্থ হাইপারথাইরয়ডিজম আর নিম্নমাত্রার T3 এর উপস্থিতির অর্থ হাইপোথাইরয়ডিজম।
TSH receptor antibody(TSI): রক্তে TSI এর উপস্থিতির অর্থ রোগী গ্রেভস রোগ এ আক্রান্ত। এই রোগে চোখের চারপাশ ফুলে উঠে।
Anti-thyroid anti-body: রক্তে antithyroid antibody এর উপস্থিতির অর্থ রোগী Hashimoto’s এবং গ্রেভস রোগ এ আক্রান্ত। Hashimoto’s এমন এক রোগ যেখানে পুরো থাইরয়েড গ্রন্থিটিই ধীরে ধীরে আক্রান্ত হয়ে যায়।
এছাড়া আরো কিছু পরীক্ষা যেমন নিউক্লিয়ার থাইরয়েড স্ক্যান, থাইরয়েড আল্ট্রাসাউন্ড, কম্পিউটারাইজড এক্সিয়াল টোমোগ্রাফি স্ক্যান (Computerized axial tomography scan) এর মত কিছু পরীক্ষার সাহায্যে ও থাইরয়েড গ্রন্থির বিভিন্ন রোগ সনাক্ত করা যায়।
সার্জারি ঃ
হাইপারথাইরয়ডিজম, গয়েটার এবং নডিউল কিংবা টিউমার হলে সেটির ক্ষেত্রে রোগের মাত্রা অনুযায়ী থাইরয়েড গ্রন্থির কিছু অংশ কিংবা পুরোটা কেটে ফেলতে হতে পারে অপারেশানের মাধ্যমে।
তবে ৭০ ভাগ ক্ষেত্রে এই গ্রন্থির অর্ধেক কেটে ফেললেও রোগী তার বাকি অর্ধেক দিয়ে স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে পারে। তবে যাদের পুরো গ্রন্থিটিই কেটে ফেলেতে হয় তাদের বাকি জীবন আলাদাভাবে বাহির থেকে প্রয়োজনীয় হরমোন গ্রহণ করতে হয়।
এছাড়া বিভিন্ন নিউক্লিয়ার মেডিসিন, তেজস্ক্রিয় আয়োডিন ব্যবহার করে আক্রান্ত হবার মাত্রা নির্ধারণ করে চিকিৎসকেরা পরবর্তী পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
সুতরাং কোনো লক্ষণ দেখলে সেটাকে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। আর সুস্থ থাকতে বছরে অন্তত একবার রক্ত পরীক্ষা করে থাইরয়েড গ্রন্থির অবস্থা চেক করতে পারেন।
Discussion about this post