ডা. মোহাম্মদ আহাদ হোসেন
কাঁধ বা শোল্ডার আমাদের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমাদের সকল কাজের জন্য হাতের সাহায্য নিয়ে থাকি। হাত নাড়াচাড়ার সঙ্গে কাঁধের নাড়াচাড়া খুবই স্বাভাবিক। এজন্য কাঁধের কোনো সমস্যা বা ব্যথা হলে তা থেকে হাতের মুভমেন্ট বাধাগ্রস্ত হয়। আর গঠনগত ভাবে কাঁধ ইনজুরি বা আঘাতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কাঁধে ব্যথা খুবই সাধারণ একটি বিষয়।
আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতি হাজার মানুষের মধ্যে ১৫ জন প্রতি বছর কাঁধে ব্যথার সমস্যায় ভূগে থাকেন। একটু অসাবধানতা থেকেই কাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কীভাবে কাঁধে ব্যথা বা ইনজুরি হয় এবং কীভাবে আমরা এর থেকে সাবধান থাকতে পারি এই বিষয়ে আজকের লেখা।
শুরুতেই কাধের গঠন সম্পর্কে একটু ধারণা দেই। আমাদের কাঁধ বা শোল্ডার কাধের একটি হাড় ও বাহুর একটি হাড় নিয়ে গঠিত। সাথে কিছু মাংসপেশি ও লিগামেন্ট থাকে যা শোল্ডার জয়েন্টকে শক্তিশালী করে। এখানে কাঁধের হাড়ে একটি ক্যাপসুল থাকে ও বাহুর হাড়ে একটি বলের মত অংশ থাকে যা ওই ক্যাপসুলের মধ্যে আটকে থাকে। জয়েন্ট টি ঝুলন্ত থাকার কারনে ও বেশি ব্যবহার হওয়ার কারনে ইনজুরির ঝুঁকিতে থাকে।
কাঁধে ব্যথার কারণ কি?
যে কোনো রোগের কারণ ছাড়াও ব্যথার মূল তিনটি কারণ হচ্ছে মাংসপেশী বা লিগামেন্টস ইনজুরি, হাড় ভেঙে যাওয়া বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং স্নায়ুতে চাপ বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। এগুলো বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে।
আঘাত জনিত ব্যথা কীভাবে হয়?
আঘাত পাওয়া যে কোনো ব্যথার অন্যতম কারণ। আঘাতের কারণে মাংস পেশী, লিগামেন্টসে বড় ধরনের বা ছোট ধরনের ইনজুরি হতে পারে। কাঁধ বা শোল্ডার জয়েন্টকে ঘিরে রাখে চারটি টেন্ডন বা লিগামেন্টস। এগুলোকে একত্রে বলে রোটেটর কাফ। আঘাতের কারণে এই রোটেটর কাফের যে কোনো লিগামেন্ট ইনজুরি হতে পারে। যে কারণে সাময়িক কাঁধে বা শোল্ডারে সাময়িক ব্যথা হতে পারে। ইনজুরি ঠিক হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় বা বিশ্রাম না দিলে বা নিয়োমিত ভাবে ব্যথার অংগ দিয়ে কাজ চালিয়ে গেলে সেই ইনজুরি থেকে দীর্ঘ মেয়াদী ব্যথা বা ক্রনিক পেইন হতে পারে। আবার অত্যধিক ভারী জিনিস তুলতে গিয়ে বা জোরে হাত টানের কারণে শোল্ডার ডিসলোকেশন বা ছুটে যেতে পারে। যে সকল আঘাতের কারণে শোল্ডারে ইনজুরি হতে পারে।
১. বাচ্চাদের জন্মের সময় শোল্ডারে ইনজুরিসহ হাড় ভেঙে যেতে পারে।
২. ছোট বাচ্চাদের হাত ধরে উঠানোর সময় জোরে টান লাগলে শোল্ডারে ইনজুরিসহ ডিসলোকেশন হতে পারে। সেক্ষেত্রে বাচ্চাদের কাঁধ ধরে উঠাতে পারেন।
৩. অত্যাধিক ভারী জিনিস তোলার কারণে মাংসপেশী ও লিগামেন্টস ইনজুরি হতে পারে।
৪. ব্যায়াম করার সময় অধিক চাপের কারণে মাংস পেশী বা লিগামেন্টস ইনজুরি হতে পারে।
৫. ক্রিকেট খেলায় যারা স্পিডে বল করে তাদের ইনজুরি হতে পারে।
কাঁধের হাড় ফেটে যাওয়া বা ভেঙে যাওয়া
আঘাতে থেকে অনেক সময় হাড় ভেঙে যেতে পারে বা ফেটে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হয়। অনেক সময় সুক্ষ্ম ফাটল খেয়াল করা হয় না। সেক্ষেত্রে তা দীর্ঘ মেয়াদী ব্যথায় রূপান্তর হতে পারে। কাঁধের হাড়ের ইনজুরির মধ্যে সাধারণ ভাবে ক্লাভিকল বা কলার বোন ইনজুরি হয়ে ব্যথা হতে পারে। আবার কাঁধের হাড় বিশেষ করে বাহুর হাড় ফেটে বা ইনজুরিতে ব্যথা হতে পারে। সাধারণত বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই ধরনের ইনজুরি হতে পারে। অস্টিও পোরোসিসের কারণে হাড় ভঙ্গুর হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি খাওয়ার দরকার হতে পারে।
ফ্রোজেন শোল্ডার
ফ্রোজেন শোল্ডার কাঁধের একটি সাধারণ সমস্যা। সাধারণত মাঝ বয়েসী থেকে অধিক বয়েসীদের এটা হতে পারে। এক্ষেত্রে কাঁধের জয়েন্টে প্রথম দিকে ভেতরের আবরণীতে প্রদাহ হয়ে ব্যথা অনুভূত হয়। যে কারণে হাত নাড়াচাড়া করা থেকে বিরত থাকেন আক্রান্ত ব্যক্তি। দীর্ঘদিন এই সমস্যা থাকলে কাঁধের জয়েন্ট শক্ত হয়ে যায়। তখন চাইলেও নাড়ানো যায় না। প্রচণ্ড ব্যথা হয়।
কারা ফ্রোজেন শোল্ডারের জন্য ঝুঁকিতে থাকেন
১. বয়স ৪০ বা তার ঊর্ধ্বে তারা এই সমস্যার জন্য ঝুঁকিতে থাকেন।
২. যে সকল কারণে শোল্ডারের মুভমেন্ট কমে যায় যেমন- রোটেটর কাফ ইনজুরি, হাত ভেঙে যাওয়া, স্ট্রোক ও অপারেশন জনিত কারণে দীর্ঘদিন শোল্ডারের মুভমেন্ট কমে যাওয়া।
৩. বিভিন্ন রোগের কারণে হতে পারে যেমন- ডায়াবেটিস, থাইরয়েড গ্রন্থির রোগ, হার্টের রোগ, যক্ষ্মা ও পারকিন্সন রোগ।
৪. যারা দীর্ঘদিন অস্টিওয়ারথ্রাইটিস বা রিউম্যাটয়েড আরথ্রাইটিসে ভুগে থাকেন তাদের ক্ষেত্রেও এই সমস্যা হতে পারে।
কীভাবে ফ্রোজেন শোল্ডার থেকে রক্ষা পাওয়া যায়?
একটু সতর্ক থাকলেই আমরা এই সমস্যা থেকে বেঁচে থাকতে পারি। আঘাতজনিত সমস্যা থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা। নিয়মিত শোল্ডারের ব্যায়াম শোল্ডারকে ভালো রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কাঁধ বা শোল্ডার যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ তাই এর কোনো সমস্যাকে হালকা করে না দেখা। দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া। শুধু ব্যথার ঔষধ খেয়ে চিকিৎসা নিজে নিজে না করা। এখন সমস্যা হচ্ছে যদি ফ্রোজেন শোল্ডার হয়ে যায় তবে কী করার আছে? এক্ষেত্রে সমাধান হচ্ছে শোল্ডারকে মুভমেন্ট করানো। যেহেতু ব্যথা হয়। ব্যথা দূর করে নিতে হবে। সেক্ষেত্রে যারা ব্যথার চিকিৎসা করেন তাদের পরামর্শ নিয়ে লোকাল ইনজেকশন নিয়ে ব্যথা কমাইয়ে নিয়ে নিয়োমিত এক্সারসাইজ করে এই ফ্রোজেন শোল্ডার থেকে রেহাই পেতে পারেন। নিয়োমিত ফিজিওথেরাপি এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে।
বাইসেপস টেনডিনাইটিস
আমাদের কাঁধে বা শোল্ডারে রোটেটর কাফের চারটি মাংশপেশীর শেষের অংশ বা টেনডন ঘিরে রাখে। বাইসেপস টেনডন তাদের মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি সামনের দিক থেকে শোল্ডারকে রক্ষা করে। কোনো কারণে এটি আঘাতপ্রাপ্ত হলে যেমন অত্যধিক ভারী কিছু উপরে তোলা, বার বার মাথার উপরের দিকে হাত জোরে জোরে ঘোরানো অথবা সরাসরি কোনো আঘাতে এতে প্রদাহ হয় ও ব্যথা হয়। সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে এটি সমাধান না করলে এটি শোল্ডারের দীর্ঘ মেয়াদী ব্যথার কারণ হতে পারে।
বাইসেপস টেনডিনাইটিস চিকিৎসা পদ্ধতি
আমরা অন্যান্য ব্যথায় ব্যায়ামের কথা বলি। কিন্তু বাইসেপস টেনডিনাইটিস হলে ব্যায়াম করা যাবে না। তাই এটা নির্ণয় করা জরুরি। যারা ব্যথার চিকিৎসা করেন তারা দেখে কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে পারেন। আবার প্রয়োজনে আল্ট্রাসাউন্ড করে নিশ্চিত হওয়া যায়। নিশ্চিত হওয়ার পর আমরা ব্যথা মুক্ত ছোট্ট ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে চিকিৎসা করে থাকি ও কিছু দিন বিশ্রাম দিয়ে থাকি। যদি দীর্ঘ মেয়াদী ব্যথা হয় সেক্ষেত্রে আমরা পিআরপি চিকিৎসা দিতে পারি।
কাঁধের অস্টিও আরথ্রাইটিস
এটা কাঁধে ব্যথার অন্যতম একটি কারণ। এক্ষেত্রে কাঁধের জয়েন্টের ভেতরের আবরণীতে প্রদাহ হয়। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ঔষধ খেতে হবে। এটা বোঝার জন্য খেয়াল রাখতে হবে যাদের এই ধরনের সমস্যা আছে তাদের শরীরের অন্যান্য জয়েন্টও ব্যথায় আক্তান্ত হতে পারে। এক্ষেত্রে জয়েন্ট ফুলে যায় ও প্রচণ্ড ব্যথা হয়। ঔষধ সেবন ও নিয়মিত এক্সারসাইজ এক্ষেত্রে উন্নতি এনে দিতে পারে। এসব রোগীদের বারবার জয়েন্টে ইনজেকশন নেয়াও ক্ষতিকর হতে পারে। তাই সাময়িক ব্যথা উপশমের জন্য বারবার ইনজেকশন নেয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। সঠিক রোগ নির্ণয় না করে জয়েন্টে কোনো ধরনের ইনজেকশন জয়েন্টে মারাত্মক ইনফেকশনের কারণ হতে পারে।
কাঁধের ব্যথায় পিআরপি
পিআরপি হচ্ছে প্লাটিলেট রিচ প্লাজমা। পিআরপি চিকিৎসা ঘাড়ের ব্যথাসহ অন্যান্য ব্যথার চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এতে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। আমাদের শরীরের নিজস্ব উপাদান দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। এতে যাকে দেয়া হবে তার শরীর থেকে ২০ সিসি রক্ত নিয়ে সেটা মেশিনে দিয়ে রক্ত থেকে প্লাজমা আলাদা করা হয়। এই প্লাজমায় প্লাটিলেটসহ অনেক গ্রোথ ফ্যাক্টর থাকে। এটা ইনজুরির জায়গায় দিলে সেখানে লোকাল গ্রোথ ফ্যাক্টর রিলিজ করে স্থায়ী ক্ষত পূরণে সাহায্য করে। এটা নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। ব্যথা নিরাময়ের স্থায়ী চিকিৎসায় এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
শেষ কথা
আমাদের শরীর ঠিক রাখার জন্য বিভিন্ন জয়েন্টসের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের মধ্যে হাত ও পায়ের জয়েন্টসের ভূমিকা অপরিসীম। কারণ সব সময়ই আমরা এদের সাহায্যে চলাফেরা করি। হাত ও পায়ের জয়েন্টস ক্ষতিগ্রস্ত হলে আমরা শারীরিক মানাসিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারি। তাই এসব জায়গা আক্রান্ত হওয়ার আগেই সতর্ক হতে হবে। কোনো কারণে আক্রান্ত হয়ে গেলে সঠিক চিকিৎসা নেয়া অত্যন্ত জরুরি। ভুল চিকিৎসার কারণে হাত ও পায়ের জয়েন্টসের কোনটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে সারাজীবনের জন্য আফসোস করতে হতে পারে। সকলেই সুস্থ থাকুন ভালো থাকুন।
লেখক: কনসালটেন্ট ও পেইন ফিজিশিয়ান, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা।
Discussion about this post