ফাইব্রোমায়ালজিয়া বলতে বুঝায় শরীরের মাংসপেশি ও টেন্ডন, লিগামেন্ট ইত্যাদির ব্যাথা ।
ফাইব্রোমায়ালজিয়া একটি দীর্ঘ স্থায়ী – মাংসপেশি ও তার সাথে সম্পর্ক যুক্ত অঙ্গের ব্যাথাকেই বুজায় – যদি ও ফাইব্রোমায়ালজিয়া প্রথম অবস্থায় শরীরের সকল অঙ্গে দেখা দেয় না , বরং যে কোন একটি অংশে দেখা দেয় যা পরবর্তীতে – দুই হাত, দুই পা, পিঠ, ঘাড় , নিতম্ব এবং হাটুর গোছালিতে ছড়িয়ে পড়ে বা অনেক সময় শরীরের কোথায় ব্যাথা হচ্ছে রোগী সঠিক ভাবে বলতে পারেনা – তখন ব্যাথা নাশক ঔষধে বা সাধারণ ব্যায়াম জাতীয় কিছু করার পর ও তেমন ভাল ফল পাওয়া যায় না — ইত্যাদি ।
অসুখটি ক্রনিক পর্যায়ে যাওয়ার পর বা বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে এবং পারিবারিক, মানসিক ( শারীরিক নির্যাতন ) , দুর্ঘটনা জাতীয় শারীরিক আঘাত, দাম্পত্য কলহ অথবা ছোটবেলায় নির্যাতনের কোনো ইতিহাস ইত্যাদি থাকলে এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা দ্রুত বৃদ্ধি পায় । ফাইব্রোমায়ালজিয়া পুরাতন বা ক্রনিক অবস্থায় চলে গেলে সাথে মাইগ্রেন জাতীয় অসুখ , মহিলাদের পি ভি আই অথবা মাসিকে অত্যধিক ব্যাথা (Dysmenorrhoea) একটু বেশী দেখা দেয় – অথবা মধ্য বয়স হওয়ার সাথে সাথে রিউমাটয়েড আরথ্রাইটিস, বাত ব্যাথা সহ শরীরের মাংসপেশির অবশতা জাতীয় সমস্যায়ই বেশী লেগে থাকে …। ইত্যাদি
কারন ঃ
ঘুমের সমস্যা, বিশেষত ডেল্টা স্লিপের পরিমাণ কমে গেলে অর্থাৎ দীর্ঘ দিন যাদের ঘুমের দ্বিতীয় ধাপে যেতে বাধা প্রাপ্ত হয়ে থাকেন তাদের বেলায় এই অসুখ টি বেশী হয় , যা রোগী নিজে কোন দিন ই বুজতে পারেনা । সে কারনেই যারা বেশী স্বপ্ন দেখেন, তারা অল্প বয়সে খুবী কম ফাইব্রোমায়ালজিয়ায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন ।
শরীরের ব্যথা নিয়ন্ত্রণকারী কেন্দ্রে কোনো সমস্যা হলে। যেমন- শরীরের নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় ব্যথা অনুভবের মাত্রা ও সহ্য ক্ষমতা কমে গেলে – ( সাবস্ট্যান্স পি, গ্লুটামেট(SubstanceP, Glutamate) এর মাত্রার অসামঞ্জস্য পরিবর্তন বা বেড়ে যাওয়ার ফলে তা হয়ে থাকে ) ।
মস্তিষ্কে কিছু কিছু নিউরোট্রান্সমিটারের পরিমাণ কমে গেলে করটিসেলের মাত্রা বেড়ে যায় তখন অসুখ টি দেখা দেয় ।
থ্যালামাসে রক্তের পরিবহন কমে গেলে অথবা কর্টিসল নামক হরমোনের মাত্রায় তারতম্য হলে অথবা হাইপোথ্যালামো-পিটুইটারি-এড্রেনাল এক্সিসে কোনো সমস্যা হলে এ রোগ দেখা দেয় ( সে সময় অটোন্যামিক নার্ভাস সিস্টেমের ব্যাঘাত জনিত কারনের লক্ষন বিদ্যমান থাকবে …। )
আঘাত জনিত কারন অথবা স্নায়ুর ইনফেকশন জনিত কারনে দেখা দিতে পারে, বিশেষ করে উপরের মেরুদণ্ড বা ঘাড়ে ভাইরাস বা ব্যাক্টোরিয়া জনিত প্রদাহের কারনে ফাইব্রোমায়ালজিয়ায় হওয়ার সম্বাভনা বেশী থাকে ।
বংশগত ধারাবাহিকতায় এই রোগ হতে পারে , বিশেষ করে যাদের পরিবারে রিউমাটয়েড আরথ্রাইটিস অথবা লোপাস জনিত অসুখের ধারাবাহিকতা আছে তাদের বেশী হওয়ার সম্ভাবনা আছেই ।
এ ছাড়া ফাইব্রোমায়ালজিয়া পুরুষের চাইতে মহিলারা বেশী আক্রান্ত হয়ে থাকেন যা প্রতি ১১ জনের মধ্যে ১০ জন ই মহিলা ।
ফাইব্রোমায়ালজিয়ার উল্লেখযোগ্য লক্ষণ ও উপসর্গ :
১- ব্যাপক ব্যথা ঃ
মাংসপেশীতে অবিরাম হালকা ব্যথা (Dull ache) থাকে যা টেন্ডার পয়েন্টস নামে শরীরের ১৮টি ব্যথাপ্রবণ জায়গায় ব্যথার মাত্রা বেশী থাকবে এবং কম পক্ষে ৯ টি পয়েন্টে ব্যাথা থাকবেই। যার ইতিহাস কমপক্ষে ৩ মাস হতে কয়েক বছরের থাকবে — বিশেষ করে যে মাংশপেশী সমূহ হাড়ের সাথে সংযোক্ত বেশী থাকে – ( নিচের চিত্র থেকে শরীরের পয়েন্ট গুলো দেখে নিন )
এবং আক্রান্ত লিগামেন্ট টেন্ডন সমুহে কামড়ানোর মত যন্ত্রণা হয়., ৬৫% বেলায় ব্যথা ঘাড় এবং কাঁধে বেশী হয়ে থাকে এবং পরবর্তীতে শরীরের উভয় পাশে এবং কোমরের উপরের ও নিচে তীব্র ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে – অনেকের হাটুর নিচের গোছারি বা বাহুর মধ্যে চড়িয়ে পড়ে । মাঝে মধ্যে অনেকের আঙ্গুলে, হাতের কব্জিতে , পায়ের আঙ্গুল, বা পায়ের মধ্যে অবসতা অনুভূত হতে পারে ।
ব্যাথা হাল্কা থেকে কঠিন হতে পারে যা জ্বলে যাওয়ার মত অনুভুত হয় , ব্যাথার অঞ্ছল শক্ত হয়ে যাওয়া, আক্রান্ত অঞ্চলের মাংসপেশি কম্পিত হওয়া ইত্যাদি ধরণের যন্ত্রণা অনুভুত হয় – এবং কোন কোন সময় আক্রান্ত অঞ্চলে ফোলে যাওয়ার মত দাগ পরিলক্ষিত হয়, যা দেখে অনেক সময় বাত- ব্যাধির ফোলার মত মনে হলেও অসুখ টি কোন সময় উক্ত অঞ্চলের মাংসপেশি অথবা হাড় ক্ষয় করার মত মারাত্মক কোন ধরণের ক্ষতি করেনা বিধায় ইহা বাত জাতীয় অসুখ নয় ।
ব্যাথা বাড়ার সাথে শরীরের নিদৃষ্ট কিছু “পয়েন্ট” এ চাপ দিলে রোগী ব্যাথা অনুভব একটু বেশী করে ।
*** উল্লেখযোগ্য ব্যথাপ্রবণ অঞ্চল সমূহ হচ্ছে ঃ
মাথার পিছনে– কাঁধের চ্যাপটা হাড়ের মাঝে (Between shoulder blades) — কাঁধের উপরে– গলার সামনের দিকে– বুকের উপরিভাগে (Upper chest)– কনুইয়ের বাইরের দিকে (Outer elbows)– নিতম্বের উপরিভাগে (Upper hips)– নিতম্বের পাশে– হাঁটুর ভিতরের দিকে (Inner knees)
২- ক্লান্তি এবং অবসাদ ঃ
অনেক ঘুম হবার পরও রোগী ক্লান্তি এবং অবসাদ অনুভব করে বা অনেক সময় মাংস পেশী ব্যাথার কারনে রোগীর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে থাকে যা মাসে ৩/৪ রাত হয়ে থাকে এবং সে সময় রোগী স্লিপ আপনিয়ায় ও পায়ের বিশ্রাম হিনতায় ((RLS) সামান্য ঘুমের মধ্যে পা চুড়তে থাকে ।
৩- কোন কিছু পরিস্কার ভাবে চিন্তা করতে বিব্রত বোধ হওয়া ঃ (called “fibro fog”)
৪- কম ব্যায়ামে সহনশীলতা – মানসিক ভীতি জনিত উদ্বেগ- খিটখিটে স্বভাব, ভুলে যাওয়ার প্রবণতা, মনোযোগহীনতা, হাত ও হাতের আঙুল ফুলে যাওয়া এবং ঝিনঝিন করা
৫ – মাথাব্যাথা– মাথা ঘোরা, চর্মের সংবেদনশীলতা, স্বাভাবিক পরিস্রম করার পর বেশী ব্যাথা অনুভব করা , পেটের ব্যথা ও বিনা কারনে পেট ডাকা , ডায়রিয়া, এবং কোষ্ঠকাঠিন্য ,আইবিএস, ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, কোনো কানে বেশি শোনা এবং ঘন ঘন ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়া ও বয়স বাড়ার সাথে সাথে লুপাস (Lupas)- ও গিঁটে বাতের অনেক লক্ষন দেখা দেয় । –
৬-প্যারাস্থেসিয়া দেখা দেওয়া Paresthesia ঃ– ( শরীরের একটি অস্বাভাবিক সংবেদনশীলতা তৈরি হওয়া – বিশেষ করে হাতের বা পায়ের আঙুল সমুহে , হাতের কুনু অথবা পায়ের গোছারিতে বেশী ট্যাঙ্গেলিং ( এক ধরণের টিংটিং শব্দ ) বা জ্বলা অনুভূত হওয়া কে বুজায় )
৭ – মহিলাদের মাসিক স্রাবের সময় ব্যাথা এবং এন্ডোমেট্রিওসিস দেখা দিতে পারে
এন্ডোমেট্রিওসিস (ইহা নারীদের এক বিশেষ ধরণের রোগ যাতে জননতন্ত্রের বিভিন্ন অংশ আক্রান্ত হয়। এরোগের আক্রমণস্থল হচ্ছে জরায়ু, যোনিদেশ, ডিম্বাশয় এবং ডিম্বনালী যা উক্ত স্থানে মিউকাস টিস্যু বা এন্ডোমেট্রিয়াম জাতীয় টিস্যু অল্প অল্প জমা হতে থাকে যার ফলে সংশ্লিষ্ট স্থানসমূহ বেদনান্বিত ও স্ফীত হয়ে নানারূপ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। একেই এণ্ডোমেট্রিওসিস (Endometriosis) বলে। দীর্ঘদিন এ রোগে ভুগলে বন্ধ্যাত্ব দেখা দেয় )
এ ছাড়া ও পরিস্থিতি ও রোগের অবস্থার উপর অন্যান্য লক্ষন দেখা দিতে পারে ।
কি ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে ঃ
এক কথায় ফাইব্রোমায়ালজিয়ার নিদৃষ্ট কোন পরিক্ষা নেই ! তার চাইতে অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা শারীরিক পরিক্ষা নিরীক্ষা করেই , খুব সহজেই অসুখটি কে চিহ্নিত করতে পারেন – রুগির ইতিহাস কম পক্ষে ৩ মাসের পুরানো থাকবে এবং সেই সাথে ১৮টি ব্যথাপ্রবণ জায়গায় ব্যথার মাত্রা দেখে রোগ নির্ণয় করা বা বুঝা সম্বভ ( কম পক্ষে ৯ টি তে কম বেশী ব্যাথা থাকবেই ) – সাথে প্রয়োজন বোধে রক্তের টি সি ডিসি – ই এস আর এবং থায়রয়েড ফাংশন টেস্ট অথবা সদ্য আবিষ্কৃত করটিসেল ম্যাজারম্যান্ট পরিক্ষা করার জন্য বলতে পারেন । তবে এক্সরে বা অন্যান্য মাল্টিমিডিয়া ডায়াগনোসিস করে কোন লাভ নেই বা অসুখটি ধরা পরার কথা নয় ।
ফাইব্রোমায়ালজিয়া অসুখ স্থায়ী হয়ে গেলে হাড়- জোড়া রোগ , নিউরোলজি ও বাত, ব্যাথা বিষয়ে অভিজ্ঞ চিকিৎ’সককেই দেখানো উচিৎ।
Discussion about this post