ডা.উম্মুল খায়ের মাহমুদা , বিশিষ্ট গাইনী বিশেষজ্ঞ ও সার্জন
গর্ভাবস্থায় কোমর ব্যথা একটি পরিচিত সমস্যা। অন্ত:স্বত্ত্বাদের কাছ থেকে প্রায়ই এ ধরণের সমস্যার কথা শোনা যায়। এছাড়া এ সময় এ ধরণের আরও কিছু সমস্যার কথা শোনা যায়। এসব ব্যথা মাতৃত্বকালীন সময়কে কঠিন করে তোলে।
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি চার জনে তিন জন নারী গর্ভাবস্থায় কোমর ব্যাথা সমস্যায় ভুগে থাকেন। এ সমস্যা সাধারণত গর্ভাবস্থার শেষ দিকে বিশেষ করে তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে বেশি দেখা যায়। মায়ের জরায়ুর যে পাশে বাচ্চা অবস্থান করে সেদিকে ব্যথা বেশি অনুভূত হয়।
গর্ভাবস্থায় কোমরে এ ধরনের ব্যথা কারো কারো জন্য তেমন সমস্যার কারণ না হলেও আবার কারও জন্য এটা মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। গর্ভাবস্থায় কোমরে ব্যথা হওয়ার কারণ ও প্রতিকার নিয়েই আজকের স্বাস্থ্য পরামর্শ।
কেন কোমর ব্যাথা হয়
*গর্ভধারণের শুরু থেকেই শরীরের কিছু হরমোনের নিঃসরণ বেড়ে যায়। এর মধ্যে প্রজেস্টেরন এবং রিলাক্সিন হরমোন সন্তান জন্মদানের প্রস্তুতি হিসেবে কোমরের বিভিন্ন জয়েন্ট এবং লিগামেন্টসকে নরম এবং ঢিলা করে দেয়। এর ফলে মায়ের শরীর অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। জয়েন্টের ভার বহন ক্ষমতা কমে যায় এবং হাঁটার সময়, অনেক বসে থাকলে, নিচে চেয়ার থেকে ওঠার সময় বা কোন কিছু তোলার সময় ব্যথা অনুভূত হয়।
*গর্ভাবস্থায় জরায়ু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্ত:স্বত্ত্বার শরীরের ভর-কেন্দ্রও পরিবর্তিত হয় এবং পেটের পেশীগুলো সম্প্রসারিত ও দুর্বল হয়ে যায়। এর ফলে মায়ের Posutre আক্রান্ত হয় এবং পিঠের উপর অতিরিক্ত চাপ পরে।
*যেহেতু মায়ের শরীর এ সময় অতিরিক্ত ওজন বহন করে তাই এ সময় মায়ের শরীরের পেশী এবং জয়েন্টগুলোর উপর চাপ বেশি থাকে। এই কারণে গর্ভাবস্থায় কোমর ব্যাথা দেখা দিতে পারে।
*মেয়েদের পেলভিসে একজোড়া লিগামেন্ট থাকে যা রাউন্ড লিগামেন্ট নামে পরিচিত। এগুলোর কাজ হোল জরায়ুকে সঠিক স্থানে ধরে রাখা। গর্ভধারণের আগে এ লিগামেন্টগুলো পুরু এবং ছোট থাকে। গর্ভধারণের পড়ে জরায়ুর আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ লিগামেন্টগুলো রাবার ব্যান্ডের মত প্রসারিত হয় এবং পাতলা হয়ে যায়। এ কারণে গর্ভাবস্থায় লিগামেন্টগুলো টান টান অবস্থায় থাকে এবং এতে হঠাৎ কোন চাপ পড়লে ব্যাথা অনুভূত হতে পারে। এ ধরনের ব্যাথাকে রাউন্ড লিগামেন্ট পেইন বলে।
*গর্ভবতী নারীরা যখন হঠাৎ অবস্থান পরিবর্তন করেন তখন সাধারণত রাউন্ড লিগামেন্ট পেইন অনুভূত হতে পারে, যেমন- বিছানা বা চেয়ার থেকে ওঠার সময়। কাশি দেয়ার সময় বা বিছানায় নড়াচড়া করার সময়ও এ ব্যাথা হতে পারে। রাউন্ড লিগামেন্ট পেইনের কারণে শারিরীক ধকল গেলেও চাপা ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
*গর্ভাবস্থায় কোমরে ব্যাথা হওয়ার আরেকটি কারণ হতে পারে সায়াটিক নার্ভের উপর অতিরিক্ত চাপ। গর্ভাবস্থায় বড় হয়ে যাওয়া জরায়ুর চাপ যখন শরীরের দুটি সায়াটিক নার্ভের উপর পড়ে তখন কোমরে, নিতম্বে বা উরুতে ব্যাথা হতে পারে। এ ধরনের ব্যাথাকে বলে সায়াটিকা ।এ ধরনের ব্যাথা সাধারণত কোমর বা কোমরের উপরে পিঠের মাঝ বরাবর হয়। এ ব্যাথা কখনো কখনো পায়ের দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়। কিছু কিছু কারণে এ ব্যথা বেড়ে যেতে পারে। যেমন- একটানা অনেকক্ষন বসে থাকলে বা দাঁড়িয়ে থাকলে বা ভারী কিছু আল্গালে। রাতের দিকে এ ধরনের ব্যাথা বেশী অনুভুত হয়। গর্ভাবস্থায় সায়াটিকার হওয়া স্বাভাবিক। তারপরও এ ধরনের ব্যথা হলে ডাক্তারকে জানানো উচিত। কারণ তা মারাত্মক কোনো কিছুর লক্ষণও হতে পারে।
কোমর ব্যাথায় কী করবেন
গর্ভাবস্থায় কোমা ব্যাথায় তেমন কোন বড় ক্ষতি না হলেও মা ও সন্তান উভয়ের জন্য চরম বিরক্তিকর। যা শান্তি নষ্ট করে দেয়। তাই অবহেলা না করে নিয়ম মেনে চলা উচিত। তিনি আরও বলেন, তবে শুরু থেকে সব সময় ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখলে এসব সমস্যায় ভুগতে হয় না।
যা করবেন
*গর্ভাবস্থায় কোমর ব্যাথা দূর করার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হল ব্যায়াম। ব্যায়াম নিজের পেশীকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি শরীরের সর্বস্তরের সুস্থতা খুব সহজেই শিশুকে বহন করার শক্তি যোগায়। তখন ওজন বৃদ্ধির পরও আপনি খুব সহজেই এবং আরামে শিশুকে বহন করতে পারবেন।গর্ভবতী মহিলাদের জন্য শ্রেষ্ঠ ব্যায়াম হল হাঁটা, সাতার কাটা এবং আসতে আসতে সাইকেল চালান। আপনি আপনার ডাক্তারের সাথে আলোচনা করে আপনার জন্য যে ব্যায়ামটি ভাল হয়, সে ব্যায়ামটি করা শুরু করেন।
*গর্ভাবস্থায় স্ট্রেচিং ব্যায়াম করলে স্বস্তি মিলতে পারে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে এ ধরনের ব্যায়াম করার সময় তা দ্রুত করা না হয় বা স্ট্রেচিং বেশী করা না হয়। এর ফলে হিতে বিপরীত হতে পারে। ব্যায়ামের সময় সব সময় নিজের শরীরের কথা শোনার চেষ্টা করুন। যখনি মনে হবে অসুবিধা হচ্ছে বা ব্যথা হচ্ছে তখন ব্যায়াম বন্ধ করুন।
*রিলাক্সেশনের টেকনিকগুলো জেনে নিন। প্রফেশনাল কাউকে দিয়ে মাসাজ করাতে পারেন। মাসাজের ফলে কিছুটা আরামাবোধ করতে পারেন। বিশেষ করে ঘুমানোর আগে হালকা মাসাজ ঘুমে সহায়তা করতে পারে। যদি প্রফেশনাল কাউকে পাওয়া না যায় তবে আপনি আপনার সঙ্গীর সহায়তা নিতে পারেন। আপনার মাথা, ঘাড়, গলা, পিঠ, হাত এবং পায়ে আলতো মাসাজ এ সময় অনেক কাজে দিতে পারে।
*আপনার ব্যাথার স্থানে গরম ও ঠাণ্ডা সেঁকা দিতে পারেন। এতে আপনি কিছু সময়ের জন্য ব্যথা থেকে পরিত্রাণ পাবেন। তবে অবশ্যই আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন। প্রথমে দুই-তিনদিন আপনার ব্যথাযুক্ত স্থানে ২০ মিনিট করে ঠাণ্ডা কম্প্রেস প্রদান করুন। এরপরে, আবার কয়েকদিন একই স্থানে গরম কম্প্রেস প্রদান করুন। কিন্তু, খেয়াল রাখবেন, গর্ভাবস্থায় কখনও পেটে ঠাণ্ডা বা গরম কম্প্রেস করবেন না।
*গর্ভবতী অবস্থায় মেরুদণ্ডের উপর বেশি চাপ পড়ে এবং অতিরিক্ত ওজন বহন করতে হয়। তাই, আপনি যখন বসে বসে কাজ করবেন, তখন সাথে একটি ছোট তোয়ালে বহন করুন এবং তা আপনার ব্যথার স্থানে লাগিয়ে রাখুন। যতক্ষণ বসে থাকবেন, সোজা হয়ে বসে থাকার চেষ্টা করুন। এতে আপনার ভাল Posture বজায় থাকবে, যা আপনার ব্যথা উপশম করতে কাজে দিবে।
*সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করুন। গর্ভবতী মায়েরা সাধারণত ঝুঁকে থাকেন। এতে মেরুদণ্ডের উপর আরও চাপ পড়ে। যদি সোজা হয়ে দাঁড়ানোটা এসময় একটু কঠিন হবে তারপরও চেষ্টা করুন যাতে দাঁড়ানোর সময় ঘাড় যাতে পেছনের দিকে থাকে। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে না থাকার চেষ্টা করুন। দাঁড়িয়ে থাকতে হলে কিছুক্ষন পর পর বসে বিশ্রাম নিন।
*গর্ভাবস্থায় ভারী জিনিস আলগানো উচিত নয়। যদি নিচ থেকে কোন জিনিস তুলতে হয় তবে ঝুঁকে না তুলে আগে হাঁটু ভেঙ্গে বসে তারপর তুলুন। বাজারের ব্যাগ বা কিছু বহন করতে হলে দু হাতে সমান ভর নেয়ার চেষ্টা করুন।
*এক হাতে ওজন বেশী নিলে শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখা কষ্টকর হয় এবং তাতে মেরুদণ্ডে চাপ পড়ে। আপনি কিভাবে ঘুমাচ্ছেন তার উপর নির্ভর করে আপনার মেরুদণ্ডের উপর চাপ পড়তে পারে এবং কোমর ব্যাথা হতে পারে। গর্ভাবস্থায় বাম পাশ ফিরে শোওয়ার চেষ্টা করুন। এতে আপনার মেরুদণ্ডের উপর চাপ যেমন কমবে তেমনি শরীরে রক্তপ্রবাহ বাঁধাগ্রস্থ হবে না। এছাড়া ঘুমানোর সময় দুপায়ের মাঝখানে বালিশ ব্যাবহার করতে পারেন যাতে উপরের পায়ের ভর বালিশের উপর পড়ে। পেটের নীচে বালিশ ব্যাবহার করতে পারেন বা পিঠের দিকে বালিশ দিয়ে সাপোর্ট দিতে পারেন।
Discussion about this post