ডা: তারেক আনোয়ার
ব্রেইন স্ট্রোক বর্তমান সময়ে মৃত্যুর একটি প্রধান কারণ। যখন কোন কারনে মস্তিষ্কের মধ্যে একটি রক্তের ধমনি বিস্ফোরিত হয় বা ধমনিতে রক্ত প্রবাহে বাধা তৈরী হয় তখন যে অবস্থা সৃষ্টি হয় তাকে ব্রেইন স্ট্রোক বা শুধু স্ট্রোক বলে। তাৎক্ষনিক চিকিৎসা ছাড়া তখন মস্তিষ্কের কোষ দ্রুত মরতে শুরু করে। ফলে গুরুতর অক্ষমতা বা মৃত্যু হতে পারে।
যদি কখনও কোন ব্যক্তির স্ট্রোকের লক্ষণ দেখা দেয়, তবে বিলম্ব না করে জরুরী চিকিৎসা প্রয়োজন।
ব্রেইন স্ট্রোক এর লক্ষণসমুহ
স্ট্রোক এর লক্ষনগুলোর মধ্যে থাকতে পারেঃ
- শরীরে হঠাৎ করে কোনো এক পাশে নিস্তেজতা অথবা দূর্বলতা অনুভব করা।
- আকস্মিকভাবে এক বা উভয় চোখের দৃষ্টির পরিবর্তন হয় এবং গিলতে অসুবিধা হয়।
- অজানা কারণে হঠাৎ গুরুতর মাথা ব্যাথা
- হঠাৎ মাথাঘোরা সহ হাঁটতে অথবা ভারসাম্য রাখতে সমস্যা হয়।
- হঠাৎ বিভ্রান্তি, অন্যদের কথা বলা বা বোঝার অসুবিধা
এই উপসর্গগুলির কোনটি লক্ষ্য করলে অবিলম্বে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
কথা বলা, হাসি ও নড়া চড়া করার মাধ্যমে স্ট্রোক হয়েছে কি না তার পরীক্ষা
F.A.S.T. পরীক্ষার মাধ্যমে স্ট্রোকের লক্ষণগুলো ধরা যায়। এই পরীক্ষা হচ্ছে:
- FACE (মুখ): হাসতে বলুন এবং দেখুন মুখের একপাশ ঝুঁকে পড়ছে কিনা?
- Arms (বাহু): বাহুদ্বয় যখন্ উঠানো হচ্ছে তখন এক পাশ কি নিচে নেমে যাচ্ছে?
- Speech (কথাবার্তা): মানুষ টি কি একটি সহজ বাক্য পুনরাবৃত্তি করতে পারছে? তার কি শব্দগুলো অস্পষ্টভাবে বা উচ্চারণ করতে কী কোনো প্রকার সমস্যা হচ্ছে?
- Time (সময়): কোনও উপসর্গ উপস্থিত থাকলে সংকটপুর্ন সময়ে অবিলম্বে তাকে হাসপাতালে নিয়ে চলুন।
স্ট্রোক: সময় = মস্তিষ্কের ক্ষতি
স্ট্রোকের চিকিৎসার জন্য প্রতিটি সেকেন্ড মূল্যবান। অক্সিজেন ছাড়া মস্তিষ্কের কোষ মিনিটের মধ্যেই মারা যায়। স্ট্রোকের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা যাওয়ার প্রথম তিন ঘণ্টার মধ্যেই (কিছু লোকের ক্ষেত্রে সাড়ে ৪ ঘন্টা ঘন্টা পর্যন্ত সময় থাকে) clot-busting টাইপের ঔষধ যেগুলো রক্ত চলাচলের বাঁধা দূর করে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করতে সাহায্য করে, প্রয়োগ করলে মস্তিষ্কের ক্ষতি হ্রাস করতে পারে। একবার মস্তিষ্কের টিস্যু মারা গেলে সেই টিস্যু দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অংশগুলি সঠিকভাবে কাজ করবে না। এই কারণে স্ট্রোক দীর্ঘমেয়াদী অক্ষমতা বা প্যারালাইসিস একটি শীর্ষ কারণ।
স্ট্রোক নির্ণয়
যখন কেউ স্ট্রোকের উপসর্গগুলি নিয়ে হাসপাতাল এ আসে, তখন প্রথম ধাপে তার স্ট্রোকের ধরন নির্ধারণ করা হয়। প্রধানত স্ট্রোক ২ প্রকার এবং সে দুটির চিকিৎসা কিন্তু এক না। একটি সিটি স্ক্যানের সাহায্য প্রথমে দেখা হয় লক্ষণগুলি রক্ত ধমনি বা রক্তাক্ত ধমনি থেকে আসছে কিনা? এছাড়াও আরো কিছু পরীক্ষা আছে যেগুলো মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ অথবা রক্তপাতের অবস্থান খুঁজতে সাহায্য করতে পারে।
Ischemic Stroke: স্ট্রোকের সর্বাধিক পরিচিত ধরনকে Ischemic Stroke বলা হয়। প্রতি ১০টি স্ট্রোকের মধ্যে প্রায় ৯টি এই বিভাগে পড়ে। জমাট বাঁধা রক্ত মস্তিষ্কের ধমনিকে রক্ত প্রবাহে বাধা দেওয়ার ফলে এটি ঘটে। রক্ত জমাট বাধার ঘটনাটি ঐ স্থানেও ঘটতে পারে বা শরীরের অন্য কোথাও জমাট বেঁধে সেখানে এসে রক্ত প্রবাহে বাঁধা সৃষ্টি করতে পারে।
Hemorrhagic Stroke: হেমোরেজিক স্ট্রোক সাধারণত কম হয় কিন্তু মারাত্মক ফলাফল নিয়ে আসে। মস্তিষ্কের ভিতর একটি দূর্বল রক্ত ধমনি যখন বিস্ফোরিত তখন এটি ঘটে। ফলে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয় যা বন্ধ করা কঠিন হতে পারে।
‘Mini-Stroke’ (TIA): এটি অনেকটা স্ট্রোক হওয়ার খুব নিকটবতী একটি ক্ষণস্থায়ী ischemic আক্রমণ, যাকে মিনি স্ট্রোক বলা হয়। রক্ত প্রবাহ কোন কারনে মস্তিষ্কের একটি অংশে অল্প সময়ের জন্য ব্যহত হয় যার ফলে এর উপসর্গগুলো আসল স্ট্রোকের মতো দেখা দেয়। যখন রক্ত আবার প্রবাহিত হয়, তখন উপসর্গগুলি অদৃশ্য হয়ে যায়। এটি একটি সতর্কীকরন সংকেত যে স্ট্রোক শীঘ্রই ঘটতে পারে। যদি মনে হয় আপনি মিনি স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন তবে অবহেলা না করে জরুরি চিকিৎসাসেবার সাহায্য নিন।
স্ট্রোক এর কারণসমুহ
স্ট্রোকের একটি সাধারণ কারণ হল atherosclerosis বা ধমনীগুলো শক্ত এবং সরু হয়ে যাওয়া। চর্বি, কোলেস্টেরল, ক্যালসিয়াম, এবং অন্যান্য পদার্থগুলি ধমনীতে আস্তরণ তৈরি করে যা রক্ত প্রবাহের যায়গা সঙ্কুচিত করে। রক্ত জমাট বেঁধে এই সংকীর্ণ স্থান দখল করে ischemic stroke ঘটাতে পারে। এছাড়াও atherosclerosis রক্ত জমাট বাধাকে সহজ করে দেয়। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপের ফলে দুর্বল ধমনি বিস্ফোরিত হয়ে হেমোরেজিক স্ট্রোক হতে পারে।
স্ট্রোকের ঝুঁকির কারণ: ক্রনিক বা দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্যসমস্যা
কিছু কিছু স্বাস্থ্যসমস্যা দীর্ঘসময় থাকলে তা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়ঃ
- উচ্চ্ রক্তচাপ
- উচ্চ কোলেস্টেরল
- ডায়াবেটিস
- স্থূলতা
এই সমস্যাগুলো কমানোর পদক্ষেপ নিয়ে আপনি স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে পারেন।
স্ট্রোকের ঝুঁকির কারণ: অভ্যাস
কিছু অভ্যাস স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়:
- ধূমপান
- অতি সামান্য ব্যায়াম
- অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান
স্ট্রোকের ঝুঁকির কারণ: ডায়েট বা খাদ্যাভাস
একটি ত্রুটিপুর্ণ ডায়েট বিভিন্ন উপায়ে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে ফল, শাকসবজি, বাদামি আটা এবং মাছ আপনার নিয়মিত খাদ্যতালিকায় রাখুন।
স্ট্রোক এর যে ঝুঁকির বিষয়গুলো আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না
কিছু স্ট্রোকের কারণ আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেমন বয়স্ক হয়ে যাওয়া বা স্ট্রোকের একটি পারিবারিক ইতিহাস থাকা । লিঙ্গ ও একটি ভূমিকা পালন করে। যেমন মহিলাদের থেকে পুরুষদের স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে, মহিলাদের ও স্ট্রোকে মৃত্যু ঘটে। এছাড়াও, জাতিগত পার্থক্য ও স্ট্রোকের কারণগুলোর মধ্যে উল্যেখযোগ্য। আফ্রিকান আমেরিকান, নেটিভ আমেরিকান এবং আলাস্কান নেটিভসরা অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষের তুলনায় অধিক স্ট্রোকের শিকার হয়ে থাকেন।
ব্রেইন স্ট্রোক এর জরুরী চিকিৎসা
ischemic stroke এর ক্ষেত্রে জরুরী চিকিৎসার মাধ্যমে রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিক করার জন্য ঔষধের উপর জোর দেওয়া হয়। clot-busting ওষুধ জমাট বাঁধা রক্তের জমাট ছুটিয়ে স্ট্রোক এর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি কমাতে অত্যন্ত কার্যকরী। কিন্তু এটি স্ট্রোকের প্রাথমিক লক্ষণ দেখার পরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব (৩ ঘণ্টার মধ্যে অথবা কিছু মানুষের জন্য ৪.৫ ঘন্টা) দিতে হবে। Hemorrhagic স্ট্রোক নিয়ন্ত্রক করা আরও কঠিন। সাধারণত চিকিৎসার মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ, রক্তপাত, এবং মস্তিষ্কের স্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে এটি মোকাবিলা করার চেষ্টা করা হয়।
ব্রেন স্ট্রোক এর দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি
স্ট্রোক দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি করবে কিনা এটি নির্ভর করে এর তীব্রতা এবং কত তাড়াতাড়ি এটির চিকিৎসা করা হয়েছিল তার উপর। কি ধরণের ক্ষতি হবে তা নির্ভর করে মস্তিষ্কের কোথায় স্ট্রোক ঘটেছে তার উপর। স্ট্রোকের পরে সাধারণ সমস্যাগুলোর মধ্যে হাত বা পায়ে অবশ ভাব অথবা দুর্বলতা, হাঁটতে অসুবিধা, দৃষ্টির সমস্যা, গিলতে সমস্যা, এবং কথাবার্তা বলা এবং বোঝার সমস্যা উল্যেখযোগ্য। এই সমস্যা স্থায়ী হতে পারে, কিন্তু অনেক মানুষ তাদের অধিকাংশ ক্ষমতা ফিরে পেয়ে থাকেন।
স্ট্রোক পুনর্বাসন
পুনর্বাসনই হচ্ছে স্ট্রোক থেকে আরোগ্য লাভের কেন্দ্রবিন্দু। এটি রোগীদের হারানো দক্ষতা ফিরে পেতে সাহায্য করে এবং যা ক্ষতি হয়েছে তা পূরণে সাহায্য করে। পুনর্বাসনের জন্য প্রচলিত থেরাপিসমুহ হচ্ছেঃ
Speech Therapy: যাদের কথা বলতে সমস্যা, কথাবার্তা এবং ভাষা থেরাপি তাদের জন্য্য অপরিহার্য। একজন ভাষা থেরাপিস্ট যাদের গিলতে কষ্ট হয় এমন রোগীদেরও সাহায্য করতে পারেন।
Physical Therapy: পেশী দুর্বলতা ও শারীরিক ভারসাম্য রাখার সমস্যা স্ট্রোকের পরে খুবই সাধারণ যা হাঁটা এবং অন্যান্য দৈনন্দিন কার্যক্রম করতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। শারীরিক থেরাপি শক্তি ও শারীরিক ভারসাম্য পুনরায় অর্জন করার একটি কার্যকর উপায়। সূক্ষ্ম কাজ যেমন একটি ছুরি এবং কাটাচামচ ব্যবহার, লেখার এবং শার্টে বোতাম লাগানোর মতো কাজের ক্ষেত্রে এই থেরাপি সাহায্য করতে পারে।
Talk Therapy: স্ট্রোক থেকে বেঁচে যাওযা এবং তাদের প্রিয়জনদের জন্য তীব্র আবেগ যেমন ভয়, ক্রোধ, উদ্বেগ এবং দুঃখ একটি সাধারণ অভিজ্ঞতা। একজন মনোবৈজ্ঞানিক বা মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শদাতা এই আবেগের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য কৌশল প্রদান করতে পারেন। এছাড়াও একজন থেরাপিস্ট বিষণ্নতার লক্ষণ দেখতে পারেন, যা স্ট্রোক থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষের উপর ঘনঘন আঘাত হানে ।
স্ট্রোক প্রতিরোধ এর জন্য জীবনধারার পরিবর্তন
যারা স্ট্রোক বা “মিনি স্ট্রোক” এর মুখোমুখি হয়েছেন তারা পুনরাবৃত্তি প্রতিরোধে পদক্ষেপ নিতে পারেন:
- ধুমপান ত্যাগ করা
- ব্যায়াম এবং স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা।
- মদ এবং লবণ খাওয়া নিয়ন্ত্রন করা ।
- বেশি বেশি সবজি, মাছ, এবং গোটা শস্য (whole grain) সমৃদ্ধ স্বাস্থ্যকর খাদ্য খাওয়া
ব্রেইন স্ট্রোক প্রতিরোধে ঔষধ
স্ট্রোকের উচ্চ ঝুঁকি আছে এমন ব্যক্তিদের ঝুঁকি কমানোর জন্য চিকিৎসকরা নানারকম ঔষধ সুপারিশ করেন। অ্যাসপিরিন সহ এন্টি-প্ল্যাটলেট ওষুধ প্লাটলেটগুলোকে একসঙ্গে আটকে থাকা এবং জমাট রক্ত গঠন থেকে বিরত রাখে। কিছু রোগীদের স্ট্রোক হওয়া থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করার জন্য Anti-clotting ঔষধ প্রয়োজন হতে পারে। পরিশেষে, যদি আপনার উচ্চ রক্তচাপ থাকে, তবে আপনার ডাক্তার তা কমানোর জন্য ওষুধ দিতে পারেন।
স্ট্রোক প্রতিরোধে অস্ত্রোপচার
ঘাড়ের প্রত্যেক পাশ থেকে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচলের যে ধমনী আছে তাকে carotid artery বলে। এই ধমনী সরু হয়ে গেলে স্ট্রোকের ঝুঁকি তৈরি হয় । যাদের এই সমস্যার কারণে হালকা স্ট্রোক বা “মিনি স্ট্রোক” হয়েছে তাদের সার্জারি থেকে উপকার হতে পারে যা ক্যারোটিড এন্ডটারোরেটমি নামে পরিচিত। এই প্রক্রিয়া ক্যারোটিড ধমনী থেকে আস্তরন সরিয়ে দেয় এবং পরবতী স্ট্রোক প্রতিরোধ করতে সাহায্য করতে পারে।
স্ট্রোক প্রতিরোধে বেলুন এবং স্টেন্ট
ডাক্তাররা কিছু ক্ষেত্রে বড় অস্ত্রোপচার ছাড়াই বাধাপ্রাপ্ত ক্যারোটিড ধমনী চিকিৎসা করতে পারেন। এঞ্জিওপ্লাস্টি নামক পদ্ধতিতে সাময়িকভাবে ধমনীতে ক্যাথাটার ঢোকানো হয় এবং একটি ক্ষুদ্র বেলুনকে ফুলিয়ে আস্তরণ দ্বারা সংকীর্ণ হয়ে যাওয়া জায়গাকে চওড়া করা হয়। এরপর ধমনি খোলা রাখতে পারে স্টেন্ট নামক এমন একটি ধাতব নল ধমনীতে ঢোকানো হয়।
স্ট্রোক খুবই ভয়ংকর একটু জিনিস। একটু অবহেলায় মৃত্যু বা প্যারালাইসিস ঘটতে পারে। তাই এটা সম্পর্কে নিজেও সচেতন হউন এবং অন্যকেও সচেতন করুন।
Discussion about this post