হার্টবিট ডেস্ক
মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের(Nervous system) দুটি অংশ৷ একটি সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম বা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র এবং অপরটি পেরিফেরাল নার্ভাস সিস্টেম বা বহিঃস্থ স্নায়ুতন্ত্র৷ কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের দুটি অংশ ব্রেইন(Brain) বা মস্তিস্ক এবং স্পাইনাল কর্ড(Spinal cord) বা মেরুমজ্জা৷ মানুষের মস্তিস্কের তিনটি অংশ-ফোর ব্রেইন বা সামনের অংশ,মিড ব্রেইন বা মধ্যের অংশ আর হাইন্ড ব্রেইন বা পেছনের অংশ৷
ফোর ব্রেইনের প্রধান অংশের নাম হল সেরিব্রাম৷ এই সেরিব্রামের দুটি অংশ ডান সেরিব্রাম ও বাম সেরিব্রাম৷ এই সেরিব্রামই প্রধানত স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়৷মস্তিস্কের সামনের অংশে আরো থাকে থ্যালামাস৷ একগুচ্ছ স্নায়ুকোষ মিলে তৈরী হয় থ্যালামাস৷ এটি মানুষের সেনসেশন বা অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে৷ তাই একে অন্যভাবে সেনসরি রিলেষ্টেশনও বলা যায়৷ মস্তিস্কের পিছনের অংশকে বলা হয় হাইন্ড ব্রেইন৷ আমাদের চলাফেরা, কথাবলা সবই নিয়ন্ত্রণ করে সেরিব্রামের কিছু বিশেষ স্নায়ুকোষ৷ এই স্নায়ুকোষগুলো কোনো কারণে মরে গেলে অথবা অকেজো হয়ে গেলে প্যারালাইসিস(Paralysis) বা পক্ষাঘাত দেখা দেয়৷
কারনঃ
প্যারালাইসিস রোগের কারণ অনেক। যেমন- স্ট্রোক(Stroke), ট্রমাটিক ব্রেইন ইনজুরি, নার্ভ ইনজুরি, ব্রেইন টিউমার, স্পাইনাল কর্ড টিউমার, মটর নিউরন ডিজিজ, পোলিও মাইলাইটিস, গুলেন বেরি সিনড্রম, প্রোলাপস ডিস্ক, ভিটামিন বি-১২ এর অভাব, স্পাইনাল কর্ড কম্প্রেসন ইত্যাদি। এসব কারণ ছাড়াও আরো কিছু কারণ আছে, যা প্যারালাইসিসের জন্য ঝুঁকি বহন করে যেমন- উচ্চ রক্তচাপ, সিগারেট, পান, ডায়াবেটিস, মদ গ্রহণ, হাইপারলিপিডেমিয়া, হৃদরোগ ইত্যাদি। তবে যেকোনো কারণে ব্রেইন বা স্পাইনাল কর্ডের টিসু নষ্ট হলে বা ওই টিসুতে চাপ পড়লে প্যারালাইসিস হতে পারে।
চিকিৎসা : চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় খুবই জরুরি। কারণ ইস্কেমিক স্ট্রোক(Ischemic stroke) বা হেমরেজিক স্ট্রোক উভয় চিকিৎসা ভিন্ন এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রোগের ধরন অনুযায়ী চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। স্ট্রোক-পরবর্তী প্যারালাইসিস বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীকে আগের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে ওষুধের পাশাপাশি আধুনিক ফিজিওথেরাপি(Physiotherapy) চিকিৎসা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ চিকিৎসার মাধ্যমে স্ট্রোক-পরবর্তী প্যারালাইসিস রোগীকে সম্পূর্ণ পুনর্বাসন করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ফিজিওথেরাপিস্টের তত্ত্বাবধানে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে দিনে নিয়মিত ৩-৪ বার ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা নিতে হবে কমপক্ষে ২ থেকে ৬ মাস।
পরিচর্যার ক্ষেত্রে-
* অজ্ঞান রোগীদের জন্য বিছানা ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে
* নাকের মাধ্যমে পরিমিত পরিমাণে খাবারের ব্যবস্থা করতে হবেষ আধা ঘণ্টা পরপর রোগীর পজিশন পরিবর্তন করতে হবে
* রোগীকে প্রস্রাব-পায়খানা করানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দরকার হলে ক্যাথেটার, বেডপ্যান ইত্যাদি ব্যবহার করতে হবে
* রোগীর শরীরের সব জোড়ার প্রতি যত্নবান হতে হবে যাতে জোড়াগুলো শক্ত হয়ে না যায়। এ জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী নির্দিষ্ট নিয়মে ব্যায়াম করাতে হবে।
* বিভিন্ন প্রকার ফিজিক্যাল থেরাপি যেমন ইনফ্রারেড, সর্টওয়েভ ইলেকট্রিক্যাল স্টিমুলেশন থেরাপি প্রয়োজন অনুযায়ী দিতে হবে।
পুনর্বাসন
রোগী যখন সুস্থ হয়ে উঠবে তখন তাকে বিভিন্ন প্রকার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে তুলতে হবে। কথা স্পষ্টভাবে বলার জন্য স্পিচ থেরাপি দিতে হবে। রোগীর হাঁটাচলার জন্য প্রশিক্ষণ দিতে হবে। প্রয়োজনে গেট ট্রেনিংয়ের আওতায় প্যারালাল বার ওয়াকিং, রোলেটর ওয়াকিং ও ক্র্যাচ ওয়াকিং এমনকি লাঠির সাহায্যে হাঁটার প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
যদি কোনো রোগী হাঁটতে অক্ষম হয় তবে তাকে হুইল চেয়ার দিয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। হাত ও পায়ের দুর্বলতার জন্য নির্দিষ্ট নিয়মে নির্দিষ্ট ব্যায়াম করতে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিবর্তন অর্থাৎ রোগীর সামর্থ্য অনুযায়ী থাকার ঘর, কিচেন, বাথরুম, অথবা অফিস কক্ষে পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন- স্যাঁতস্যাঁতে ফ্লোর বা স্লিপি ফ্লোরকে কার্পেট দিয়ে মুড়ে দেয়া, প্রয়োজনীয় হাতল দিয়ে চলাচলের সুবিধা করে দেয়া, বাথরুমে উঁচু কমোড তথা ধরে বসার জন্য ব্যবস্থা করে দেয়া ইত্যাদি।
এই পরিবর্তন রোগীর প্রয়োজন অনুযায়ী করতে হবে। রোগীর যতটুকু সামর্থ্য আছে তার আলোকে তাকে কোনো কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে এবং তাকে আয় করার জন্য ব্যবস্থা করে দিতে হবে। যেমন- একজন প্যারাব্লেজিক অর্থাৎ যার পা দুটো প্যারালাইজড কিন্তু হাত দিয়ে কাজ করতে পারে, তাকে একটি ক্ষুদ্র ব্যবস্থা যেমন- পান দোকানের ব্যবস্থা করে দেয়া যেতে পারে।
দৈনন্দিন কাজের জন্য তাকে কিছু এডাপ্টিভ ডিভাইজের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।সর্বোপরি তার আমোদপ্রমোদ তথা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারার ব্যবস্থা করে দিতে হবে, যাতে সে মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে পারে।
এ ক্ষেত্রে সমাজসেবকরা যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে। এভাবে যদি একজন প্যারালাইসিসে আক্রান্ত প্রতিবন্ধীকে চিকিৎসা তথা পুনর্বাসন করা যায় তবে সেও হয়ে উঠতে পারে সমাজের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং এভাবেই একজন প্রতিবন্ধী সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। তাই আসুন, আমরা সবাই প্যারালাইসিসে আক্রান্ত প্রতিবন্ধী ব্যক্তির চিকিৎসায় সহায়তা করি এবং তাকে সমাজের একজন কর্মক্ষম ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তুলি।
Discussion about this post