হার্টবিট ডেস্ক
আপনি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ ঘুম ভেঙে জেগে উঠলেন। চোখ খুলে মনে হলো অদৃশ্য কেউ আপনার বুকের উপর চেপে বসে আছে। চিৎকার করতে চাইলেন কিন্তু মুখই খুলতে পারলেন না। আপনি ছুটে পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে অনুভব করলেন, আপনি সম্পূর্ণ চলৎশক্তিহীন। অদৃশ্য শয়তানটি আপনার শ্বাসরোধ করার চেষ্টা করছে, আপনি কোনো প্রতিরোধই করতে পারছেন না।
পুরো ঘটনাটি স্টিফন কিং এর কোনো গল্পের অংশ মনে হলেও আসলে চিকিৎসাবিজ্ঞানে এটির রয়েছে খুব সাধারণ ব্যাখ্যা, যার নাম ‘স্লিপ প্যারালাইসিস’। বাংলায় বলে ‘বোবায় ধরা’। পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষ জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে এই ভয়ানক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন। এই ঘটনাটি কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। স্লিপ প্যারালাইসিসের সময়ে ভিজ্যুয়াল অথবা অডিটরি হ্যালুসিনেশন হওয়াও আশ্চর্যজনক কিছু নয়। এজন্য প্রায় মানুষই এটিকে কোনো ভূত বা ভিনগ্রহের প্রাণীর আক্রমণ মনে করে ভুল করে থাকেন।
১৮৬৭ সালে সিলাস মিশেল নামের এক ডাক্তার স্লিপ প্যারালাইসিস নিয়ে প্রথম গবেষণা করেন। তিনি বেশ কিছু মানুষকে স্লিপ প্যারালাইসিস অবস্থায় পর্যবেক্ষণ করে একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করেন। তবে মিশেল এর পর্যবেক্ষণের আগে পৃথিবীজুড়ে স্লিপ প্যারালাইসিস সম্পর্কে নানা কুসংস্কার চালু ছিলো। মধ্যযুগে ইউরোপিয়ানরা মনে করত, এটি ইনকিউবাস নামক প্রচণ্ড যৌনক্ষুধাসম্পন্ন এক দৈত্যের কাজ।
স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলের লোকজন মনে করত এটি মেয়ার নামক এক ডাইনীর কাজ, যে ঘুমন্ত মানুষের পাঁজরের উপর এসে বসে থাকে। তুর্কিরা ভাবত এটি বদ জিনদের কাজ, যারা মানুষকে ঘুমন্ত অবস্থায় শ্বাসরোধ করতে আসে। থাই উপকথায় আছে, ফি আম নামক এক দেবতা ঘুমের মধ্যে মানুষের উপর চেপে বসে চোখের নিচে কালো দাগ এঁকে যায়। নেপালিরা ভাবতো খ্যাক নামক এক ভূতের বাসস্থান হলো খাটের তলায়, রাতের বেলায় সে চেপে বসে পাঁজরের উপর।
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা
স্লিপ প্যারালাইসিসের জন্য ভূত প্রেতকে দায়ী করা যতটা সহজ, এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ততটাই জটিল। আধুনিক বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, যখন অস্বাভাবিকভাবে ঘুমের আরইএম (র্যাপিড আই মুভমেন্ট) ও জাগরণ দশা একইসঙ্গে কাজ করে তখনই স্লিপ প্যারালাইসিসের মতো ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয় মানুষ। স্বাভাবিক আরইএম চক্র চলার সময় মানব মস্তিষ্ক বেশ কিছু সেন্সরি স্টিমুলাই এর মধ্য দিয়ে যায়, যেটাকে আমরা বলি স্বপ্ন। স্বপ্নের সময়টাতেও মস্তিষ্ক থাকে সম্পূর্ণ অসচেতন ও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। স্বপ্ন চলাকালীন সময়ে বিশেষ কিছু নিউরোট্রান্সমিটারের ক্ষরণ হয়,যা আমাদের দেহের প্রায় সবগুলো পেশিকে অবশ করে দেয়। এই ব্যাপারটিকে বলে আরইএম অ্যাটোনিয়া। এজন্যই স্বপ্নে প্রচণ্ড ভয়ানক কিছু আমাদের ধাওয়া করলেও আমরা দৌড়ে উঠে পালাই না!
স্লিপ প্যারালাইসিসের সময়েও কোনো ব্যক্তি আরইএমের মধ্যেই থাকে, স্বপ্ন চলতে থাকে, দেহের পেশি থাকে অবশ। শুধু স্বাভাবিক আরইএমের মতো এখানে মস্তিষ্ক অসেচতন ও ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে না, হঠাৎ জেগে উঠে সম্পূর্ণ সচেতন হয়ে ওঠে। কিন্তু মাংসপেশি অবশ থাকায় স্লিপ প্যারালাইসিসের সময় মনে হয়ে থাকে কেউ বোধ হয় আক্রমণ করেছে! এ কারণেই শুরু হয় হ্যালুসিনেশন। কিন্তু একই সঙ্গে যে আতঙ্ক, নিঃশ্বাসে অসুবিধা অনুভূত হয়, মনে হয় যে কেউ বুকের উপর চেপে বসে আছে, এমনটা কেন হয়?
আরইএম স্টেজে যে আরইএম অ্যাটোনিয়া হয়, সেটি শ্বাস-প্রশ্বাসের স্বয়ংক্রিয় কার্যক্রমেও ব্যাঘাত ঘটায়। যে কারণে শ্বাস প্রশ্বাস আরো হালকা ও দ্রুত করে দেয়। স্বাভাবিকের বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড দেহে প্রবেশ করে ও অক্সিজেন সংকট তৈরি হয়। তাই স্লিপ প্যারালাইসিস বা বোবায় ধরা অবস্থায় নিশ্বাস নেয়াটা কষ্টকর। কারণ আরইএম অ্যাটোনিয়া আমাদের শ্বসনতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এজন্য ভয় আরো বেড়ে যায়। অনেকেরই প্রায় প্রতি রাতেই স্লিপ প্যারালাইজড হয়ে থাকে। এটি অনেক সময়ই স্লিপ ডিসঅর্ডার এর কারণে হয় আবার অনেকে সারা জীবনে দু’একবার এ ভয়ানক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন।
কীভাবে বাঁচবেন
ঘুমের মধ্যে এমন ধরনের সমস্যা হলে ঘুমানোর সময় বদলে ফেলতে পারেন। তবে ঘুমানোর সময়ে বারবার বদল এলে নিদ্রাহীনতা আপনাকে কাবু করবে। ফলে নানা ধরনের সমস্যায় পড়বেন। তাই নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যান। এবং স্লিপ সাইকেল তৈরি করুন।
রিল্যাক্স করুন
ক্লান্তি ও উদ্বেগ স্লিপ প্যারালাইসিসের সমস্যা তৈরি করতে পারে। যার ফলে রাতে দুঃস্বপ্ন দেখতে পারেন। ফলে ঘুমের মধ্যে নানা ধরনের সমস্যা কমাতে হলে ক্লান্তি ও উদ্বেগ কমিয়ে ফেলুন।
ডাক্তারের পরামর্শ
স্লিপ প্যারালাইসিস দশজনের মধ্যে ৪ জনের হতে পারে। তবে তার মানেই যে সেই মানুষ অসুস্থ তা নয়। অনেক সময় বাইপোলার ডিসঅর্ডার বা নারকোলেপসি’র কারণে এই ধরনের সমস্যা হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
ধারণা স্পষ্ট করুন
আপনার এই ধরনের সমস্যা থাকলে তা নিয়ে অযথা ভীত না হয়ে সমস্যা সম্পর্কে জানুন, অবগত হোন। আপনি সমস্যায় লড়তে শিখলে অনেক শক্ত হাতে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারবেন।
তবে আপনি যে দলেরই হয়ে থাকুন না কেন, আজ থেকে জেনে রাখুন, বোবা ভূত বলে কিছু নেই। আপনি ক্ষণিকের জন্য স্লিপ প্যারালাইজড হয়ে আছেন, মারা যাচ্ছেন না!
Discussion about this post