ডা. মিজানুর রহমান কল্লোল, জেনারেল ও ল্যাপারোস্কপিক সার্জন
পেনাইল ক্যান্সার একটি রোগ, যাতে পেনিস বা লিঙ্গের টিস্যুতে ম্যলিগন্যান্ট বা ক্যান্সারযুক্ত কোষগুলির অনিয়ন্ত্রিতভাবে সংখ্যাবৃদ্ধি হয়। এটি একটি বিরল ধরণের ক্যান্সার, যা চল্লিশোর্ধ্ব পুরুষদের মধ্যে দেখা যায়।
পুরুষাঙ্গের যেকোনো স্থানে ক্যান্সার হতে পারে। তবে সবচেয়ে বেশি হয় পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগের চামড়া অথবা মাথায় (লিঙ্গমুণ্ডুতে)। সাধারণত এই ক্যান্সার ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করে। প্রাথমিক অবস্থায় রোগ ধরা পড়লে চিকিৎসায় সেরে যায়। আমেরিকায় লিঙ্গ বা পুরুষাঙ্গের ক্যান্সার খুব বিরল। প্রতি ১ লাখ পুরুষের মধ্যে মাত্র একজন বা দু’জন। যেসব ছেলেশিশুর খতনা করা হয়েছে তাদের মধ্যে লিঙ্গের ক্যান্সার নেই বললেই চলে। বাংলাদেশে অনেক পুরুষের লিঙ্গের ক্যান্সার দেখা দেয়, বিশেষ করে যেসব পুরুষের খতনা করানো হয় না। দুঃখজনক ব্যাপার হলো কিছু পুরুষ ক্যান্সার ছড়িয়ে যাওয়া না পর্যন্ত চিকিৎসকের দ্বারস্থ হন না।
প্রায় সব লিঙ্গের ক্যান্সার হলো ত্বকের ক্যান্সার। এর সবচেয়ে সাধারণ ধরনটি হলো স্কোয়ামাস সেল কার্সিনোমা, যার সাথে ত্বকের অন্য অংশের যেমন মুখ বা হাতের স্কোয়ামাস সেল কার্সিনোমার মিল রয়েছে। কিছু লিঙ্গের ক্যান্সার হলো মেলানোমো, যেগুলো নীল-বাদামি চ্যাপ্টা গ্রোথ হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং যার প্রবণতা থাকে দ্রুত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার। মাঝে মাঝে লিঙ্গের গভীর টিস্যুতে ক্যান্সার হয়। এটার নাম সারকোমা। ত্বকের যে জায়গায় প্রথম ক্যান্সার দেখা দেয়, সে জায়গায় ক্যান্সার ধীরে ধীরে বড় আকারে ছড়াতে থাকে। শেষ পর্যন্ত এটা লিঙ্গের শরীরের ভেতরে গভীর টিস্যুতে ছড়িয়ে পড়ে এবং কুঁচকির লিম্ফনোডগুলোতে বা তলপেটে ছড়িয়ে যায়।
যদি ক্যান্সার শুধু লিঙ্গে সীমাবদ্ধ থাকে এবং আশপাশে কুঁচকি এলাকার লিম্ফনোডে ছড়িয়ে না পড়ে, তাহলে চিকিৎসার মাধ্যমে তা সারানো যেতে পারে। কিন্তু ক্যান্সার যদি একবার তলপেটের লিম্ফনোডে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে তা আর সারানো সম্ভব হয় না। একবার লিঙ্গের ক্যান্সার ধরা পড়লে, তা লিঙ্গ থেকে শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়েছে কি না তা নিরূপণ করার জন্য বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে।
ক্যান্সার ছড়ানোর বিভিন্ন স্তর রয়েছে: স্তর ১: ক্যান্সার কোষ কেবল লিঙ্গের মাথায় ও মাথার চামড়ায় দেখা যায়। স্তর ২: ক্যান্সার কোষ লিঙ্গের মাথার গভীর টিসুতে দেখা যায় এবং কোষগুলো লিঙ্গের শরীরে ছড়িয়ে যায়। স্তর ৩:ক্যান্সার কোষগুলো লিঙ্গে দেখা যায় এবং কেষাগুলো কুঁচকি এলাকার লিম্ফনোডগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। স্তর ৪: ক্যান্সার কোষগুলো সমস্ত লিঙ্গে এবং কুঁচকির লিম্ফনোডগুলোতে দেখা যায় এবং শরীরের অন্য অঙ্গগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে।
লিঙ্গের ক্যান্সারের কারণ ও ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো: যেসব পুরুষের জন্মের সময় খতনা করা হয়, তাদের অধিকাংশেরই পরে কখনো লিঙ্গের ক্যান্সার হয় না। বয়ঃসকিালে খতনা করালে পরে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা কিছুটা বেশি থাকে, আর যেসব পুরুষ প্রাপ্ত বয়স্ককালে খতনা করান, তাদের লিঙ্গে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি যারা কখনোই খতনা করাননি, তাদের চেয়ে মোটেই কম নয়। সাধারণ অর্থে লিঙ্গের ক্যান্সার হলো অপরিচ্ছন্নতার অসুখ। এটা বিশ্বাস করা হয় যে, লিঙ্গের মাথার চামড়ার নিচে জমে থাকা কোষগুলো (স্মেগমা) চুলকানি বা জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করে এবং ক্যান্সার ঘটায়।
যেসব পুরুষের যৌনাঙ্গে ভাইরাসজনিত আঁচিল হয় তাদের লিঙ্গে ক্যান্সার হওয়ার অনেক ঝুঁকি থাকে। ভাইরাসজনিত আঁচিল (কনডাইলোমা অ্যাকুমিনাটা) এবং লিঙ্গের ক্যান্সারের মধ্যে একটা সম্পর্ক রয়েছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে কিছু নির্দিষ্ট ধরনের ভাইরাস (হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস-টাইপ ১৬ ও ১৮) কনডাইলোমাটা এবং লিঙ্গের ক্যান্সার ঘটায়। এসব হিউমান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) মহিলাদের ভেতরেও দেখা যায় যাদের জরায়ু মুখের ক্যান্সার রয়েছে। যে মহিলার জরায়ু মুখের ক্যান্সার রয়েছে, সেই মহিলার সাথে কোনো খতনা না করানো পুরুষ যৌনমিলন করলে সেই পুরুষের লিঙ্গে ক্যান্সার হওয়ার উচ্চ ঝুঁকি থাকে।
লিঙ্গের ক্যান্সারের উপসর্গ:
যৌনাঙ্গের ক্যান্সারের লক্ষণ প্রকাশ পায় এর ত্বকেই। লক্ষণগুলো সম্পর্কে ধারণা নিন।
১. ত্বকে গুটি ওঠে যা ৪ সপ্তাহ পরও ভালো হয় না। এটাকে অনেকটা আঁচিল, আলসার বা ফোস্কার মতো দেখা যায়।
২. যৌনাঙ্গের ভেতর থেকে বা ত্বক থেকে রক্ত বের হওয়া।
৩. এমন কিছু বের হওয়া যার গন্ধ বিদঘুটে।
৪. যৌনাঙ্গে ফোরস্কিন টেনে নামাতে না পারা।
৫. র্যাশ বা ফুসকুরি ওঠা।
৬. যৌনাঙ্গের রং বদলে যাওয়া।
৭. কুঁচকিতে মাংসপিণ্ড দেওয়া দেওয়া।
৮. ক্লান্তি বোধ করা।
৯. পেটে ব্যথা হওয়া।
১০. হাড়ে ব্যথা।
১১. ওজন কমতে থাকা।
রোগ নির্ণয়:
শারীরিক পরীক্ষার সময়, আপনার চিকিত্সক আপনার লিঙ্গটি দেখবেন এবং উপস্থিত যে কোনও গলদা, জনতা বা ঘা দেখাবেন। যদি ক্যান্সারের সন্দেহ হয় তবে আপনার ডাক্তার সম্ভবত বায়োপসি করবেন y একটি বায়োপসি লিঙ্গ থেকে ত্বক বা টিস্যু একটি ছোট নমুনা অপসারণ জড়িত। ক্যান্সার কোষ উপস্থিত কিনা তা নির্ধারণ করার জন্য নমুনাটি বিশ্লেষণ করা হয়।
যদি বায়োপসি ফলাফলগুলি ক্যান্সারের লক্ষণগুলি দেখায়, আপনার ডাক্তার ক্যান্সারটি ছড়িয়ে পড়েছে কিনা তা দেখতে একটি সিস্টোস্কোপি করতে চাইতে পারেন। সিস্টোস্কোপি একটি পদ্ধতি যা সিস্টোস্কোপ নামে একটি যন্ত্র ব্যবহার জড়িত। একটি সিস্টোস্কোপ হ’ল একটি পাতলা নল যা একটি ছোট ক্যামেরা ।
সিস্টোস্কোপির সময় আপনার ডাক্তার আলতো করে লিঙ্গ খোলার মধ্যে এবং মূত্রাশয়ের মাধ্যমে সিস্টোস্কোপটি আলতোভাবে প্রবেশ করান। এটি আপনার ডাক্তারকে লিঙ্গ এবং আশেপাশের কাঠামোগুলির বিভিন্ন অঞ্চলগুলি দেখতে দেয়, ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে কিনা তা নির্ধারণ করা সম্ভব করে।
কিছু ক্ষেত্রে, লিঙ্গটির একটি এমআরআই কখনও কখনও তা নিশ্চিত করার জন্য পরিচালিত হয় যে ক্যান্সারটি পুরুষাঙ্গের গভীর টিস্যুগুলিতে আক্রমণ করেছে না।
চিকিৎসা: চিকিৎসা নিরূপণ করা হয় টিউমারের আকার ও স্তর দেখে। যদি টিউমারটি ছোট এবং এক জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকে তাহলে লিঙ্গের কাজে বিঘ্ন না ঘটিয়ে কিংবা লিঙ্গে বড় ধরনের ক্ষতি না করে অপারেশন, রাসায়নিক দ্রবণ বা রেডিয়েশন কিংবা লেজারের মাধ্যমে চিকিৎসা করা যেতে পারে। যদি ক্যান্সার লিঙ্গের টিসুর গভীরে ঢুকে যায় কিংবা টিউমারটি বড় হয় তাহরে বেশির ভাগ পুরুষের ক্ষেত্রে সার্জারিই হলো পছন্দনীয় চিকিৎসা। রেডিয়েশনও দেয়া যেতে পারে, কিন্তু তার ফল অতটা ভালো নয়। যদি টিউমার লিম্ফনোডে ছড়িয়ে যায় তাহরে সার্জারি বা রেডিয়েশন প্রয়োগ করা হয়। বিস্তৃত লিঙ্গের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে কেমোথেরাপি তেমন একটা কাজে আসে না।
ডা. মিজানুর রহমান কল্লোল, জেনারেল ও ল্যাপারোস্কপিক সার্জন
Discussion about this post