ডা. সজল আশফাক
দাঁত অমূল্য সম্পদ। খাবার চিবানো কিংবা কথা বলতে সাহায্য করা ছাড়াও ভুবন ভোলানো হাসি তৈরিতে দাঁতের জুড়ি নেই। দাঁতের বাইরের ঝকঝকে সাদা আবরণ হলো এনামেল। এই এনামেল বিভিন্নভাবে দাঁতের প্রতিরক্ষা করে। ফলে এনামেল ক্ষতিগ্রস্থ হলে দাঁতের আসল গঠন ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। দাঁতের এনামেল ক্ষতিগ্রস্থ হয় এমন একটি রোগ হচ্ছে ডেন্টাল ক্যারিজ।
প্রতিদিন আমরা অনেক কিছুই খেয়ে থাকি, কিন্তু খাওয়ার পর দাঁত পরিষ্কার করতে ভুলে যাই। এর ফলে দাঁতের গোড়ায় মাড়ির ওপর যে সাদা বা হলদেটে পদার্থ বা পরত (Dental Plaque) জমে, সেটিই শক্ত হয়ে দাঁতের পাথর(Calculus) তৈরি হয়। আর যে চিকিৎসার মাধ্যমে চিকিৎসকগণ দাঁতের এই হলদে পাথর অপসারণ করেন তারই নাম হলো স্কেলিং (Scaling)। স্কেলিং হলো দাঁত পরিস্কার করার চিকিৎসা, দাঁত সাদা করার নয়। দাঁতের চিকিৎসকগণ আল্ট্রাসনিক স্কেলার নামক মেশিনের সাহায্যে কম্পন সৃষ্টির মাধ্যমে দাঁতের স্কেলিং (পাথরগুলো অপসারণ) করে থাকেন। যথাযথ কৌশল জেনে এবং অনুসরণ করে স্কেলিং করলে দাঁতের ক্ষতি হওয়ার কোনও আশংকা থাকে না। স্কেলিংয়ের মাধ্যমে দাঁতের পাথর অপসারণের পাশাপাশি দাঁতের মাঝে কোন প্রকার কালো দাগ থাকলে তাও দূরীভূত হয়ে যায়। আমাদের আশেপাশেই অনেক ডেন্টাল সার্জনের কাছে অনেক কম খরচেই (৮০০-১,৫০০ টাকা) দাঁতের স্কেলিং করা যায়।
দাঁতের পাথরের ক্ষতিকর দিকগুলো হলোঃ-
– দাঁত ও মাড়ির মধ্যে বাধার সৃস্টি করে হাড় ক্ষয় ও মাড়ি ক্ষয় করে-মাড়ির সাথে দাঁতকে আটকে রাখার ক্ষমতা হ্রাস পায়- মুখে দুর্গন্ধ হয়- রক্ত পড়ে-শিরশির করে- দাঁতের শেকড় উন্মুক্ত হয়ে যায় – দাঁত দ্রুত নড়ে যায় ও পড়ে যায়।
কখন স্কেলিং করাবেনঃ
একবার স্কেলিং করার পরে নিয়মানুযায়ী সঠিকভাবে ব্রাশ করলে দীর্ঘদিন স্কেলিং এর প্রয়োজন হয়না।যখন দাঁতের গোড়ায় দৃশ্যমান হালকা হলুদাভ বা কালো অংশ দেখা দিলে স্কেলিং করাতে হবে।
কারা স্কেলিং করবেন
স্ক্লেলিং করার প্রয়োজনীতা নির্ভর করে একজন মানুষের লালার ওপর।
কারো লালা ভারী কারো লালা পাতলা। ভারী লালা যাদের তাদের স্কেলিং বেশি প্রয়োজন পড়ে কারণ মুখ ওয়াশআউট কম হয়।
এছাড়া যাদের কোষ্ঠকাঠিন্য আছে।
যাদের হজমে অসুবিধা হয়।
যাদের শক্ত খাবার খাওয়া অভ্যাস কম।
যাদের নরম ও মিষ্টি খাবার খাওয়ার প্রবণতা বেশি তাদের স্কেলিং করার প্রয়োজন পড়ে।
এছাড়া যাদের সিস্টেমিক ডিজিজ, ডিএম, সিকেডিসহ বিভিন্ন জটিল রোগ আছে তাদের বিশেষ যত্ন প্রয়োজন পড়ে।
দাঁতে স্কেলিং কতদিন পর পর করবেন
স্কেলিং সাধারণত ৬ মাসে একবার করা প্রয়োজন। কারও কারো ক্ষেত্রে ১ বছরে ১ বার করার প্রয়োজন হয়। তবে বুদ্ধিমানের কাজ হলো ৬ মাস পর পর ডেন্টিস্টের কাছে যেয়ে চেকআপ করা।
স্কেলিং কেন করবেন?
অনেকদিন ধরে মাড়িতে প্রদাহ (Gingivitis) ও দাঁতের গোড়ায় পাথর (Calculus) বিনা চিকিৎসায় পড়ে থাকলে এক সময় দাঁতের সকেটের হাড় ক্ষয় হয়ে দাঁতের শিকড় আস্তে আস্তে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। দাঁতকে মাড়ির সাথে আটকে রাখা পেরিওডন্টাল লিগামেন্ট ক্ষতিগ্রস্থ হয়, ফলে দাঁত নড়বড়ে হয়ে যায়। কিন্তু দাঁতগুলো পাথর দিয়ে ঢেকে থাকার কারণে এই ক্ষয়ক্ষতিগুলো চোখে পড়ে না। স্কেলিং করে এই পাথর (Calculus) অপসারণ করলে ভেতরের কি অবস্থা তা জেনে নেওয়ার পাশাপাশি সঠিক চিকিতসাও করা যায়। অর্থাৎ স্কেলিংয়ের কারণে মাড়ি আলগা বা দাঁত ফাঁকা ও নড়বড়ে হয় না বরং প্রদাহের কারণেই এগুলো হয়ে থাকে, স্কেলিংয়ের ফলে সেটা প্রকাশ পায় মাত্র।
স্কেলিংয়ের মাধ্যমে এই পাথর সরিয়ে ফেলার কারণে দাঁত গুলো সাময়িক সময়ের জন্যে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে।এই কারণে স্কেলিং করানোর পর কিছুদিন দাঁত শিরশির করতে পারে। মাড়ি স্বাভাবিক অবস্থানে ফিরে এলেই এই সমস্যা কেটে যায়। দাঁতে অল্প পাথর জমা হতেই যদি স্কেলিং করিয়ে ফেলা যায় তবে চিকিৎসা পরবর্তী এই শিরশিরে ভাব বেশি দিন স্থায়ী হয়না।
মাড়িতে প্রদাহ (Gingivitis) থাকলে মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়ে, দাঁত শিরশির করে। কিন্তু এই প্রদাহ যখন তীব্রতর প্রদাহ (Periodontitis) তে রূপ নেয় তখন মাড়ির ভেতর পুঁজ জমে যন্ত্রণাদায়ক ফোঁড়া (Abscess) সৃষ্টি হতে পারে। প্রদাহ বাড়তে থাকলে একসময় দাঁত যখন নড়তে শুরু করবে, তখন ঠিক ভাবে খাওয়া দাওয়া করা যাবেনা, যার প্রভাব পড়বে আমাদের পুরো শরীরে। এরপর একসময় দাঁত পড়ে যেতে শুরু করবে। তীব্রতর প্রদাহের সঙ্গে রক্তনালীতে চর্বি জমা, হৃদরোগ, রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে না আসা, এসকল শারীরিক জটিলতারও যোগসুত্র থাকতে পারে বলে মনে করা হয়।
স্কেলিং করালে দাঁতের ক্ষতি হয় না
অনেকের ধারনা স্কেলিং করলে দাঁতের ক্ষতি হয়,দাঁত শিরশির করে, চোখের ক্ষতি হয়।বাস্তবতা হলো- দাঁতের সমস্যায় চোখের সম্পৃক্ততা নাই- দাঁত শিরশির সাময়িক করতে পারে( ক্ষেত্র বিশেষে) তবে ক্ষনস্থায়ী এবং দাঁতকে মজবুত রাখতে অতীব জরুরী।
দাঁতের ক্ষয়রোগ বা ডেন্টাল ক্যারিজের অন্যতম কারণ হচ্ছে ডেন্টাল প্লাক। দাঁতের গায়ের এই ময়লা আস্তরণ দাঁত ব্রাশ করে দূর করা সম্ভব হয় না। এ জন্য দাঁত স্কেলিং করতে হয়। কিন্তু অনেকেরই ধারণা দাঁত স্কেলিং করলে দাঁতের ক্ষতি হয়। কেউ কেউ ভাবেন এতে দাঁত পাতলা হয়ে যায়, দাঁত ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। প্রকৃত সত্য হচ্ছে দাঁত স্কেলিং করালে দাঁতের ক্ষতি হয় না কিংবা দাঁত পাতলা হয়ে যায় না। বরং দন্ত বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এতে করে দাঁত পরিস্কার হয় এবং মুখে দুর্গন্ধ থাকে না। সর্বোপরি দাঁত রক্ষা পায় বেশ কিছু ক্ষতির হাত থেকে।
আজকাল দাঁত স্কেলিং করার জন্য আলট্রাসনিক স্কেলিং পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি একটি সহজ ও নিরাপদ পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে দাঁতের গায়ে লেগে থাকা ডেন্টাল প্লাক, দাঁতের পাথর ও দাগ দূর করা যায়। দাঁতের এই দাগ এটা সেটা দিয়ে তোলা উচিত নয় বরং তাতে দাঁতের ক্ষতি হতে পারে। স্কেলিং সম্পর্কে অনেক বাজে কথা প্রচলিত আছে। দন্ত বিশেষজ্ঞদের মতে সেগুলোর প্রায় সবই অপপ্রচার এবং অজ্ঞতাপ্রসূত ধারণা।
লেখক : বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
Discussion about this post