ড. আনোয়ার খসরু পারভেজ
গবেষক ও অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রেষণে কোষাধ্যক্ষ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা
করোনাভাইরাসের প্রকোপ ও মৃত্যু উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। রোগীর জন্য হাসপাতালে বেড খালি পাওয়া যাচ্ছে না। আইসিইউ বেডের জন্য রীতিমতো হাহাকার পড়ে গেছে। জানা যায়, বাংলাদেশে মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের পরিবর্তে দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ (পরীক্ষাকৃত নমুনার ৮১ শতাংশ) বেশি হয়েছে। (সূত্র :আইসিডিডিআর’বি)। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, স্বাস্থ্যবিধি না মানা এর অন্যতম প্রধান কারণ। এই কারণটি আরও নির্দিষ্ট করলে বলা যায়, গণপরিবহন এবং বাজারঘাটে যাতায়াতকারী জনমানুষের মধ্যে বর্তমানে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বেশি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, টিকা নেওয়ার পরও যে কেউ আবারও আক্রান্ত হতে পারেন। দেশে ইতোমধ্যে প্রায় ষাট লাখ মানুষ প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন। দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার পর কতজনের মধ্যে কী পরিমাণ করোনা নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে এবং তা কতদিন স্থায়ী হয় এ বিষয়ে দেশে জরুরিভিত্তিতে গবেষণা প্রয়োজন। নতুন ভ্যারিয়ান্ট অনেক (প্রায় ৭০ শতাংশ) দ্রুত ছড়ায় ও তীব্র অসুস্থতা ও মৃত্যুঝুঁকি বাড়ায়, বিশেষত যাদের ডায়াবেটিস ও কো-মরবিডিটি (অন্যান্য রোগে আক্রান্ত) আছে।
আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী, তরুণরাই এখন অনেক বেশি বের হয়। তাদের মাধ্যমেই শারীরিকভাবে দুর্বলদের মাঝে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের তথ্য বলছে, নবজাতক থেকে শুরু করে তরুণ কিংবা বয়স্কদের মধ্যেও এসব ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি দেখা গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন স্ট্রেইন আসবে, এটাই স্বাভাবিক। নতুন স্ট্রেইন আসার পথতো রুদ্ধ করা হয়নি। আন্তর্জাতিক যোগাযোগের সব রাস্তা খোলা রয়েছে।
জিনোম সিকোয়েন্স বা জিননকশাই ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ডিটেক্ট করার গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড। কিন্তু নমুনা হতে একটি নতুন ভ্যারিয়েন্ট জিনোম সিকোয়েন্স করতে প্রায় দশ দিন লাগে, আর তা ব্যয়বহুল। এটা করতে উন্নতমানের ল্যাব, প্রযুক্তি ও গবেষক প্রয়োজন। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তা ব্যয়বহুলও বটে। তবে বাংলাদেশে দক্ষ মাইক্রোবায়োলজিস্ট রয়েছেন এবং আশার কথা হলো, তারা এ কাজসহ রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবেন। ‘থ্রি-জিন পিসিআর’ ইউকে স্ট্রেইন শনাক্ত করতে সক্ষম। সম্প্রতি ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গ্রুপ মাল্টিপ্লেপ পিসিআর দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল ও ইউকে করোনার তিনটি ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্নকে জিনোম সিকোয়েন্স ছাড়াই ডিটেক্ট করতে পেরেছে। বাংলাদেশের ১১৮ কেন্দ্রে পিসিআর পরীক্ষার সুবিধা রয়েছে। আমরা মনে করি নমুনা শনাক্ত করার পাশাপাশি যদি ভ্যারিয়েন্ট সহজেই শনাক্ত করা যায় তাহলে এটির চিকিৎসা ও বিস্তার রোধে তা অনেকাংশে হবে সহায়ক। রোগ নিয়ন্ত্রণে ফাইজার, মডার্না, রাশিয়া, চীন যে কোনো মাধ্যম থেকে পাওয়া টিকা গণহারে দেওয়ার পাশাপাশি করোনাভাইরাসের ভ্যারিয়েন্টগুলোর উপস্থিতির জেনোমিক ডাটা এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সার্ভিলেন্স করা দরকার। এই ভাইরাস প্রতিরোধে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা এবং এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রকৃতপক্ষে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে বেশির ভাগ ভাইরাস, বিশেষ করে এমআরএনএ ভাইরাস প্রাকৃতিকভাবেই অনেক বেশি মিউটেশন করে। যে ভ্যারিয়েন্টগুলো বেশি ছড়াবে এখন তাদেরই বেশি পাওয়া যাবে। আমরা এখন হয়তো দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে কথা বলছি, পরে দেখা যাবে নতুন অন্য আরেক ভ্যারিয়েন্ট আসবে। অথবা দেশেই নতুন কনজারভেটিভ মিউটেশনের মাধ্যমে নতুন ভ্যারিয়েন্টের উদ্ভব হবে। এটাই স্বাভাবিক এবং তা প্রাকৃতিকভাবেই ঘটবে। তাই ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করতে হবে। বিশেষজ্ঞ গবেষকরা নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কীভাবে বাড়ানো যায়, তা নিয়ে কাজ করছেন। দেশেও এ বিষয়ে গবেষণা করার বিশেষজ্ঞ গবেষক রয়েছেন। প্রয়োজন শুধু উন্নতমানের ল্যাব। আমাদের এখন দেশেই ভ্যাকসিন উৎপাদনের বিষয়ে ভাবা জরুরি এবং তা যেন আমাদের দেশের ভ্যারিয়েন্টগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর হয়। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে দেশজুড়ে লকডাউন দিয়েও মানুষকে আটকে রাখা যাচ্ছে না। পেটের তাগিদে মানুষ এখন ঘর থেকে বের হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন দুই ধরনের পরিকল্পনা। প্রথমটি স্বল্পমেয়াদি। যেমন দুই/তিন সপ্তাহের কঠোর লকডাউন। দ্বিতীয়টি দীর্ঘমেয়াদে জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। করোনা নিয়ন্ত্রণে এলে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানো যেতে পারে। তবে সকল সামাজিক অনুষ্ঠান ও জনসমাগম বন্ধ রাখা উচিত।
সাহস জাগে এবং আশাবাদী করে তোলে, করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি আমাদের নিজের কাছেই রয়েছে। নিজের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে শরীরে দুর্গ গড়ে তোলাই হবে যথাযথ আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা। নিয়মমাফিক ঘুমাতে হবে। প্রতিদিন ১৫-৩০ মিনিট ব্যায়াম করতে হবে। ভিটামিন-ডির জন্য প্রতিদিন রোদ পোহাতে হবে। ভিটামিন সি-সমৃদ্ধ ফল-মূল, শাকসবজি বেশি বেশি খেতে হবে। প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। প্রতিদিন লেবু দিয়ে গরম পানি খাওয়া যেতে পারে।
মাইক্রোবায়োলজির একজন গবেষক হিসেবে আমার মনে হয় সতর্কতা ও জনসচেতনতার মধ্য দিয়েই করোনা প্রতিরোধ সম্ভব। সবাইকে নিজের ও দেশের প্রয়োজনে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’-এর মতো ‘নো মাস্ক, নো মুভমেন্ট’ বা ‘মাস্ক মাস্ট’ বিধিমালা প্রণয়ন ও প্রচার জরুরি। নিজেকে এবং নিজ পরিবারকে নিরাপদ রাখার জন্য তাই সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
Discussion about this post