ডা: মো: হুমায়ুন কবীর
সিফিলিস প্রধান যৌন রোগগুলোর মধ্য অন্যতম। এটি একটি জটিল যৌন সংক্রামক রোগ। পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় ১২ মিলিয়ন মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়। এ রোগ দেহে দীর্ঘকালীন জটিলতা দেখা দেয়। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা না করালে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। আমাদের দেশে এ রোগের প্রভাব ব্যাপক, বিশেষ করে শহর এলাকায় রোগটি সচরাচর দেখা যায়। বন্দরনগরী ও শিল্পনগরীতে এ রোগটি সাধারণত দেখা যায়।
সংক্রমণের উৎস কী
আক্রান্ত ব্যক্তির ত্বক ও শ্লেষ্মাঝিল্লির ক্ষত, ক্ষত হতে নিঃসৃত রস, লালা, যোনি থেকে নিঃসৃত রস, যোনি থেকে নিঃসৃত রক্ত, বীর্য আক্রান্ত ব্যক্তির ঠোঁট ও মুখ।
কিভাবে সংক্রমিত হয় :
আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে সৃষ্ট সিফিলিটিক ক্ষত এর সরাসরি সংস্পর্শে এলে জনান্তরে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে।
আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে সরাসরি যৌনমিলন করলে।
অনিরাপদ যৌনি মিলন, বিশেষ করে পায়ুপথে যৌন মিলন কিংবা মুখ মৈথুন কিংবা চুম্বন বিনিময় করলে।
আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর থেকে রক্ত গ্রহণ করলে।
রক্তসঞ্চালন বা ইনজেকশনের মাধ্যমে ও এ রোগ ছড়ায়।
আক্রান্ত মা সন্তান জন্মদানের আগেই শিশুর দেহে বিস্তার ঘটিয়ে দেন।
আক্রান্ত মায়ের দুধ পান করলে।
বিশেষ করে সবার মনে রাখার প্রয়োজন, এ রোগ কখনোই খাওয়ার পাত্র, চামচ, গামছা, ন্যাপকিন, সুইমিং পুল, বাথটাব কিংবা ব্যবহৃত কাপড়চোপর দিয়ে ছড়ায় না।
লক্ষণ কী :
সিফিলিসের প্রথম লক্ষণ যেমন দেরিতে (অর্থাৎ ২১ দিন পর) প্রকাশ পায়, তেমনি শেষ পর্যায়ে যেতেও অনেক সপ্তাহ, মাস বা বছর পেরিয়ে যায়।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সিফিলিস আক্রান্ত পুরুষের লিংগমুণ্ড কিংবা লিংগমুণ্ডের ত্বকে ছোট শক্ত গোটা, ফুসকুড়ি দেখা দেয়। নারীর ক্ষেতে যৌনির ঠোঁট বা ক্লাইটেরিসে শক্ত গোটা ওঠে।
রোগের প্রকোপ তিন লক্ষণ প্রকাশের সময়কালকে চারটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়
প্রাইমারি পর্যায় : ২১ দিন পর একটি মাত্র সিফিসিটিক ক্ষত প্রকাশিত হয়। প্রথমে শরীরে পোকার কামড়ের মতো গোল গোল দাগ দেখা যায়। এটি নারীর ক্ষেত্রে ক্লাইটেরিস ও পুরুষের ক্ষেত্রে লিঙ্গমুণ্ডের ত্বকে গোটা হয়। যৌনাঙ্গ ছাড়াও এটি মলদ্বার, ঠোঁট বা স্তনের বোঁটাতেও হতে পারে। কাছাকাছি গ্রন্থিগুলো ফুলে উঠতে পারে। মাঝে মধ্যে এগুলো ব্যথাহীন এবং শক্ত হয়ে দেখা দেয়। একে শ্যাঙ্কার বলা হয়।
মাধ্যমিক পর্যায় : সংক্রমণের ছয় সপ্তাহ পর শরীরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফুসকুড়ি দেখা দেয়। সিফিলিটিক ক্ষতগুলো অমসৃণ, লাল বা লালচে-বাদামি দাগ হিসেবে হাত-পায়ের তালুতে দেখা দেয়। ক্ষত ছাড়াও জ¦র, লসিকা গ্রন্থি ফোলা, গলাভাঙা, মাথাব্যথা, বিভিন্ন স্থানের চুল ঝরে যাওয়া, ওজন কমে যাওয়া, পেশিব্যথা, ক্লান্তি ইত্যাদি এ পর্যায়ে দেখা দেয়। যখন আক্রান্ত রোগী তীব্রভাবে সংক্রমিত হয়, তার মুখের ত্বক যদি ছিঁড়ে যায় তাহলে চুমুর মাধ্যমেও রোগ ছড়াতে পারে। প্রায় এক বছরের মধ্যে রোগের চিহ্নগুলো মিলিয়ে যায়।
সুপ্ত পর্যায় : এ পর্যায়ে আক্রান্তের দেহে কোনো ক্ষত, ফুসকুুড়ি বা অন্যান্য লক্ষণ দেখা যায় না। বছরের পর বছর এ পর্যায় অব্যাহত থাকতে পারে।
বিলম্বিত পর্যায় : জীবাণুুতে প্রথম সংক্রমিত হওয়ার প্রায় ১০-২০ বছর পর সিফিলিস পূর্ণাঙ্গরূপে আবির্র্ভূত হয়। রোগের বিলম্বিত পর্যায়ে রোগীর স্নায়ু, চোখ, হৃৎপিণ্ড, রক্তকণিকা, যকৃত, গ্রন্থি ও সন্ধির ক্ষতি সাধন করে। ফলে পেশি সঞ্চালনে বিঘœ ঘটে, দেখা দেয় পঙ্গুত্ব, হতবুদ্ধি ও অস্থিরবিত্ত। এ অবস্থায় রোগীর মৃত্যুও হতে পারে।
জন্মগত সিফিলিস :
গর্ভাবস্থায় আক্রান্ত মায়ের কাছ থেকে গর্ভফুলের মাধ্যমে গর্ভস্থ শিশু সিফিলিসে আক্রান্ত হতে পারে। এ ধরনের এক-তৃতীয়াংশেরই গর্ভপাত হয় কিংবা মৃত সন্তান প্রসব ঘটে। প্রাথমিক গর্ভাবস্থায় মায়ের চিকিৎসা করালে শিশু রক্ষা পায়।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা :
সেরোলজিক্যাল পরীক্ষার মাধ্যমে সিফিলিসের জীবাণু ধরা পড়ে। সিফিলিসে আক্রান্ত হওয়ার চার সপ্তাহ থেকে সেরোলজিক্যাল পরীক্ষাগুলো পজিটিভ হয়। মাঝে মধ্যে ভ্রান্তিমূলক পজিটিভ হতে পারে। ভিডিআরএল এবং আরপিআর পরীক্ষা অন্য সংক্রমণ কানেকটিভ ইস্যুর অসুখে পজিটিভ হয়। ফলাফল বিশেষ পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত করা যায়। যদি সিফিলিস সন্দেহ করা হয় তাহলে লাইপয়ডাল অ্যান্টিজেন এবং বিশেষ পরীক্ষাগুলো একত্রে করা হয়।
সুপ্তস্তরে স্নায়ুজনিত অসুস্থতা পৃথক কিংবা নিশ্চিত করার জন্য সিএসএফ পরীক্ষা করা হয়।
সিফিলিসের সেরোলজিক্যাল পরীক্ষা :
– ভিডিআরএল (ভেনেরাল ডিজিজ রিসার্স ল্যাবরেটরি) পরীক্ষা।
-আরপিআর (র্যাপিড প্লাজমা রিয়াজিন)
-টিপিএইচএ (ট্রেপোনেমা প্যালিডাম হেমাগ্লুটিনেশন অ্যাসেই)।
-এফটিএ-এবিএস (ফ্লুরোসেন্ট ট্রেপোনেমাল অ্যান্টিবডি এবসর্বড)
-ট্রেপোনেমাল এনজাইম-লিংকড ইম্যুনোসরবেন্ট (ঊখওঝঅ)।
চিকিৎসা : সিফিলিসের লক্ষণ জানা থাকলে প্রাথমিক পর্যায়ে সহজেই চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়। এ রোগ হলে স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই চিকিৎসা নেয়া উচিত, অন্যথায় এ সংক্রমণ সঙ্গীর কাছ হতে আবার হতে পারে। সম্পূর্ণ নিরাময় না হওয়া পর্যন্ত যৌন মিলন থেকে নিজেকে বা অন্যকে বিরত রাখতে হবে।
প্রতিরোধ : সিফিলিস থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে স্থায়ী সঙ্গীর সাথে জীবনযাপন করা। ভিন্ন সঙ্গীর কথা চিন্তাই করা উচিত নয়। সিফিলিস থাকলে অবশ্যই চিকিৎসা করাতে হবে। সিফিলিস আক্রান্তদের সাথে যৌন মিলন থেকে বিরত থাকতে হবে। তা ছাড়া অ্যালকোহল ও মাদক জাতীয় দ্রব্য থেকে দূরে থাকা একান্ত বাঞ্ছনীয়। কারণ এসব পান বা সেবন যৌন আচরণকে উসকে দেয়, তখন সঙ্গী নির্বাচন নাও হতে পারে। যারা কমার্শিয়াল সেক্স ওয়ার্কার, তাদের কাছ থেকে যতটা সম্ভব নিরাপদ থাকতে হবে। এ রোগ কোনোভাবেই পুষে রাখা যাবে না।
Discussion about this post