- ডা. মীর রাশেখ আলম অভি, এমবিবিএস (ডিএমসি), এফসিপিএস (সার্জারি) বিশেষ ট্রেনিং বৃহদন্ত্র ও পায়ুপথ সার্জারি
কারণ ছাড়াই খাওয়া ঠিক মতো হজম হয় না, মাঝে মাঝে ব্যথা, পেটে গ্যাস এবং পায়খানার সমস্যা। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় ইরিটাবল বাওয়েল সিন্ড্রোম (আইবিএস)।
চিকিৎসকদের কাছে পরিপাকতন্ত্রের এরকম সমস্যা নিয়ে বহু রোগী আসেন। এই রোগকে সহজ বাংলায় দীর্ঘময়োদী আমাশয় বা বিরক্তিকর পেটের সমস্যা বলা যেতে পারে।
বিশ্বে শতকরা ১১ জন এই রোগ ভুগে থাকেন। মহিলারা পুরুষদের তুলনায় সামান্য বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন। যদিও যে কোনো বয়সের মানুষই আইবিএস’য়ে আক্রান্ত হতে পারেন। তবুও কিশোর বয়সে বা বয়ঃসন্ধিকালে আইবিএস বেশি হয়ে থাকে এবং ৫০ বছর বয়সের পর এ রোগের প্রাদুর্ভাব কিছুটা কমে।
এই রোগের লক্ষণগুলো রোগীভেদে বিভিন্ন রকম হতে পারে। অনেক সময় অন্য রোগের মতো বলে মনে হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়:
* পেটে ব্যথা (সাধারণত খাবার পর পেট কামড়িয়ে ব্যথা হয় এবং পায়খানা হওয়ার পর আরাম বোধ হয়)। * পেট ফোলা ফোলা অনুভূত হওয়া। * পেটে গ্যাস। * ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য, কখনও কখনও দুটোই। * মলদ্বার শ্লেষ্মো বা পচ্ছিলি পদার্থ যাওয়া। * অতিরিক্ত বায়ু ত্যাগ। * অসম্পূর্ণ মল ত্যাগ। * দ্রুত বাথরুম যাওয়ার অনুভূতি।
আইবিএস কোষ্ঠকাঠন্যি বা ডায়রিয়া প্রধান অথবা দুটোর সংমশ্রিণ হতে পারে। আমাদের দেশে ডায়রিয়া প্রধান রোগ বেশি দেখা যায়।
প্রধান সমস্যাগুলোর পাশাপাশি কেউ কেউ ক্লান্ত, উদ্যমহীনতা, দুঃশ্চিন্তা, পিঠ ব্যথা, প্রস্রাবের সমস্যা এবং অসুস্থতা বোধ করেন। অধিকাংশ রোগীর কিছুদিনের জন্য সমস্যাগুলো প্রকট হয় ওঠে এবং কিছুদিন পর কমে যায়। অথবা সম্পূর্ণ ভালো হয় যায়। কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে খাবার বা পানীয় এই সমস্যার সূত্রপাত করে।
এক এক জনের ক্ষেত্রে এক এক খাবার বা পানীয় পেটে সহ্য হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমস্যা করে এরকম খাবারগুলো হল-
* তেলসমৃদ্ধ খাবার (পোলাও, বিরিয়ানি ইত্যাদি)। * ভাজাপোড়া খাবার। * শাক। * চা, কফি (ক্যাফেইন সমৃদ্ধ পানীয়)। * কোমল পানীয় (কার্বনেইটেড ড্রিংকস)। * মচমচে খাবার (চিপস, বিস্কুট)। * চকলেট। * অ্যালকোহল।
একে পেটের কার্যগত রোগ বলে। অর্থাৎ পেটের গঠনগত কোনো সমস্যা বা ক্রটি না থাকার পরও পেটের সমস্যা অনুভূত হওয়া। আইবিএস’য়ের যথাযথ কারণ অজানা। তবে অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ মনে করেন এটি বদহজম এবং অন্ত্রের অতিসংবদেনশীলতার (Hypersensitivity) জন্য হয়ে থাকে।
এ কারণে আইবিএস কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। চিকিৎসকরা রোগীর সমস্যা শুনে রোগ নির্ণয় করে থাকেন। তবে আইবিএস’য়ের সমস্যাগুলোর সঙ্গে যদি অতিরিক্ত ওজন হ্রাস, পেটে চাকা, মলের সঙ্গে রক্ত, রক্তশূণ্যতা বা পরিবারের কারও অন্ত্র ক্যান্সারের ইতিহাস থাকে সেক্ষেত্রে কোলোনোস্কপি করার প্রয়োজন হয়।
আইবিএস রোগীরা আইবিএস’য়ের পাশাপাশি অ্যানাল ফিসার, রেক্টাল প্রোলাপ্স এবং পাইলস’য়ে আক্রান্ত হতে পারেন।
এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। রোগের প্রকৃতি অনুধাবন করা চিকিৎসকের একট গুরুত্বপূর্ণ অংশ। রোগের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে আইবিএস নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। চিকিৎসক যদি রোগীকে তার রোগ সম্পর্কে এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল বুঝিয়ে বলেন তবে রোগী উপকৃত হন।
খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন আইবিএস চিকিৎসার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু বিভিন্ন রোগী বিভিন্ন খাদ্যে সমস্যা বোধ করেন তাই রোগীকেই খেয়াল রাখতে হবে তার কোন কোন খাবারে সমস্যা হয় এবং সেগুলো এড়িয়ে চলতে হবে। তারপরও কিছু সাধারণ নির্দেশনা রয়েছে।
* নিয়মিত খাদ্য গ্রহণ এবং সময় নিয়ে খাওয়া। * দুবার খাবার গ্রহণের মাঝখানে বেশিক্ষণ বিরতি না দেওয়া। * প্রতিদিন কমপক্ষে আট গ্লাস পানি পান করা। * চা, কফি কম খাওয়া (প্রতিদিন তিন কাপের বেশি না)। * কোমল পানীয় বা মদ পরিহার করা। * ফল কম খাওয়া (একবার একটি আপেল বা অর্ধেক কমলা)। * দুধ এবং দুগ্ধজাত খাবার (ঘি মাখন, পায়েস, মষ্টি ইত্যাদি) এড়িয়ে চলা। * যাদের কোষ্ঠকাঠন্যি – প্রধান রোগ তারা ওটস, বার্লি, রাই, কলা, আপেল, গাজর, আলু, সুবর্ণ তিসি ইত্যাদি খাবার এবং পানি বেশি খাবেন।
* যাদের ডায়রিয়া – প্রধান রোগ তাদের ফল ও সবজির খোসা, শাঁস ও দানা, শস্যজাতীয় খাবার, তুষ, সরিয়াল, বাদাম, বীজ ইত্যাদি এড়িয়ে চলতে হবে।
আইবিএস’য়ের সঙ্গে মনরোগের কিছু উপাদান পাওয়া যায়। দেখা যায় যারা অতিরিক্ত দুঃশ্চিন্তা এবং মানসিক চাপে থাকেন তাদের আইবিএস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে এবং এদের অনেকে পরীক্ষা কিংবা চাকুরীর সাক্ষাৎকারের আগে আইবিএস’য়ের সম্মুখীন হন।
তবে এটা মনে করা ঠিক নয় সমস্যাটি কেবলমাত্র মানসিক কারণেই হয়। এ কারণে মানসকি চাপ মুক্ত থাকা আইবিএস চিকিৎসায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মেডিটেইশন, ইয়োগা ইত্যাদি করে মানসিক চাপ থেকে মুক্ত থাকা যায়। প্রয়োজনে মনরোগবিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
নিয়মিত ব্যায়াম অনেক রোগীর ক্ষেত্রে আইবিএস নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে। সাইকেল চালানো, দৌড়ানো, সাঁতার কাটা ইত্যাদি ব্যায়াম করা যেতে পারে। সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট গা ঘামানো ব্যায়াম করা উচিত। নিয়মিত ব্যায়াম মানসিক চাপ মুক্ত থাকতেও সাহায্য করে।
চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ ব্যবহার করা উচিত নয়। প্রোবায়োটিক, অ্যান্টি-স্পাজমটিক, অ্যান্টি-মটিলিটি ওষুধ, মানসিক বিষণ্নতার প্রতিক্রিয়া লাঘব করার জন্য ব্যবহৃত ওষুধ ইত্যাদি আইবিএস চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়।
আইবিএস চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগী এবং চিকিৎসক দুজনেরই ধৈর্য্য প্রয়োজন। চিকিৎসক সময় নিয়ে রোগীর সঙ্গে রোগ সম্পর্কে আলোচনা করলে রোগী সাহস পান যে তার রোগটি কঠিন কোনো রোগ নয় এবং এর চিকিৎসা রয়েছে। রোগীদের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রিত, সুশৃঙ্খল ও মানসিক চাপ মুক্ত জীবনযাপন এবং খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করে আইবিএস নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
Discussion about this post