ডা. দিদারুল আহসান
গনোরিয়া রোগটি আমাদের দেশের অশিক্ষিত ও দরিদ্র সমাজে প্রমেহ নামে পরিচিত। আসলে এটি একটি জীবাণুবাহিত রোগ। Neisseria gonorrhea নামক এটি জীবাণু দ্বারা রোগটি হয়ে থাকে। পৃথিবীজুড়ে এ রোগটির বিস্তৃতি যৌন রোগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
নারী পুরুষের জটিল যৌন রোগ গুলির মধ্যে গনোরিয়া এমন একটি রোগ যা কেবল যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে এক পুরুষ থেকে অন্য নারীতে বা এক নারী থেকে অন্য পুরুষে সংক্রমিত হতে থাকে। এ রোগের ক্ষেত্রে রক্তের সঙ্গে জীবাণু সংস্পর্শ খুবই কম। এটি বংশ পরম্পরায় সংক্রমিত হয় না। সাধারণত নারী বা পুরুষের যৌনাঙ্গে এ জীবাণু ক্ষত সৃষ্টি করে থাকে। এ ক্ষতে পুঁজ সৃষ্টি হয়। এ পুঁজ যদি অন্য নারী বা পুরুষের যৌনাঙ্গে স্পর্শ করে তাহলে এ জীবাণু তাদের যৌনাঙ্গে প্রবেশ করে। সেখানে বাসা বাঁধে এবং ক্ষতের সৃষ্টি করে।
যেভাবে ছড়ায় : রোগাক্রান্ত সঙ্গী বা সঙ্গিনীর সঙ্গে দৈহিক মিলনের পর ৩ থেকে ১০ দিনের মধ্যে এ রোগের প্রকাশ ঘটে। রোগের আক্রমণ স্থল পুরুষের ক্ষেত্রে মূত্র পথের সম্মুখ অংশে জীবাণু সংক্রমণ শুরু করে এবং উপযুক্ত চিকিৎসা না হলে তা প্রস্টেটগ্রন্থি, এমনকি মূত্রথলি, উপান্ত বা শুক্রাশয় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে।
উপসর্গ (পুরুষ) : পুরুষের যৌনাঙ্গের বিভিন্ন গ্রন্থি, প্রস্টেটগ্রন্থি, শুক্রনালি, এপিডাইডাইমিস আক্রমণ করে তীব্র প্রদাহ সৃষ্টি করে। এর ২/১ দিন পর প্রচুর পরিমাণ, ঘন সাদা বা সামান্য হলদে রঙের পুঁজ পড়তে শুরু করে। প্রস্রাব করতে তীব্র জ্বালা অনুভূত হয়। পুরুষাঙ্গের মাথায় পুঁজ জাতীয় পদার্থ লেগে থাকতে দেখা যায়। এ রোগে পুরুষাঙ্গের গায়ে কোনো ঘা বা ক্ষত লক্ষ করা যায় না। হাত দিয়ে ধরলে হালকা ব্যথা অনুভূত হয়। কিছুদিন পর রোগের উপসর্গ আরও কমে যায়। তার মানে কিন্তু রোগটি ভালো হওয়া নয়; বরং রোগটি দীর্ঘমেয়াদি বা ক্রোনিকরূপ লাভ করে বলে ধরে নিতে হবে।
উপসর্গ (মহিলা) : আক্রান্ত হওয়ার পর যোনিপথের গ্রন্থি, বিশেষ করে জরায়ুর মুখের গ্রন্থিগুলোকে এ জীবাণু আক্রমণ করে থাকে। পরবর্তী পর্যায়ে ডিম্বনালিকে আক্রমণ করে। যোনিপথের ঠিক সামনেই রয়েছে মূত্রপথ, সেখানেও আক্রমণ ঘটতে পারে। ফলে যোনিপথ ও মূত্রপথ উভয়ই আক্রান্ত হয় এবং অল্প বা অধিক পরিমাণে পুঁজ বের হতে দেখা যায়। প্রস্রাবে তীব্র ব্যথা, জ্বালা দেখা দেয়, পুঁজ নিঃসরণ হতে দেখা যায়। আবার ডিম্বনালি দিয়ে জীবাণু দেহের গভীরে প্রবেশ করতে পারে।
জটিলতা (পুরুষ) : শুক্রনালি বন্ধ হয়ে যেতে পারে, উপ-শুক্রাশয় (এপিডাইডাইমিস) নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ফলে যৌনরসে বীর্যকোষ থাকে না, ফলে ওই ব্যক্তি সন্তানের পিতা হতে পারে না। রোগটি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার ফলে সে যার সঙ্গে দৈহিক মেলামেশা করবে, সেই এই রোগে আক্রান্ত হবে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি হওয়ার ফলে প্রস্টেটগ্রন্থির প্রদাহ হতে পারে। ফলে প্রস্রাব আটকে যায় বা বন্ধ হয়ে যায়।
জটিলতা (মহিলা) : দীর্ঘদিন আক্রান্ত থাকলে ডিম্বনালির ছিদ্রপথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ফলে ভবিষ্যতে তার সন্তান হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে যেতে পারে। প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া, ব্যথা ছাড়াও মূত্রাশয়ের প্রদাহ হতে পারে। আক্রান্ত মহিলা সন্তান প্রসব করলে সন্তানের চোখ এ জীবাণু দিয়ে আক্রান্ত হতে পারে। নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই হাঁটু বা গোড়ালিতে পুঁজ জমে গিরা ফুলে যেতে পারে এবং বাত ব্যথার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
প্রতিকার : ১. জনসাধারণকে যৌন রোগের কুফল সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। এছাড়া প্রয়োজন উপযুক্ত যৌন শিক্ষা প্রচলন। ২. পতিতালয় বা বহুনারী গমনে নিরুৎসাহিত করতে হবে। কারণ বেশিরভাগ মহিলারই এ রোগের কোনো লক্ষণ থাকে না। তাই যে কোনো সময়ে এদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। ৩. রোগের লক্ষণ দেখা মাত্রই চিকিৎসা করানো উচিত। ৪. আক্রান্ত অবস্থায় স্ত্রী মিলনের বা স্বামী সহবাসে বিরত থাকা উচিত, তা না হলে তারাও আক্রান্ত হতে পারে। ৫. সর্বোপরি বিবাহিত যৌন জীবন সবার জন্য বিভিন্ন যৌন রোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একমাত্র পথ।
ভয়াবহ ক্ষতিকর দিকগুলো :- এ রোগ হলে পুরুষের চেয়ে নারীদেরই বেশি ক্ষতি হয়। নারীর সঙ্গে তার সন্তানেরও ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি। নিচে সেদিকগুলো তুলে ধরা হলো। নারীর ডিম্ববাহী ও নারীর ডিম্বকোষ আক্রান্ত হলে তার সন্তান জন্ম চিরদিনের জন্য বন্ধ্য ও নারী বন্ধ্যত্ববরণ করতে পারে। কখনো কখনো গর্ভবতী হওয়ার প্রথম অবস্থায় ওই রোগ হলে গর্ভস্থ ভ্রূণ গর্ভপাত হয়ে পড়ে যায়, তার জরায়ু থেকে প্রচুর রক্তপাত হতে থাকে। গর্ভের শেষ অবস্থায় এ রোগ হলে সন্তান জন্মের সময় তার চোখে রোগের পুঁজ লেগে শিশু অন্ধ হয়ে যেতে পারে।
- চর্ম, যৌন ও এলার্জি রোগ বিশেষজ্ঞ
Discussion about this post