ডা. নুজহাত চৌধুরী
স্থান: আমার চাকরি ক্ষেত্র—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
দৃশ্যপট: ১
আমি: আপনি মাটিতে থুতু ফেললেন কেন?
রোগীর সাথে আসা প্যান্ট-শার্ট পরা ছেলে: থুতু আসলে কি করবো?
আমি: থুতু মানুষ যেখানে সেখানে ফেলে?
ছেলেটি আমার দিকে চোখ গরম করে তাকাল।
আমার এবার সত্যি মেজাজ গরম হয়ে গেল। প্যান্ট-শার্ট পরা শিক্ষিত ছেলে! এটুকু বুঝে না? এ কেমন শিক্ষা!
আমি: আপনি জানেন, থুতুতে কত জীবাণু থাকে? শুধু করোনা না, অনেক রোগ ছড়ায় থুতুর মধ্য দিয়ে। যেখানে সেখানে থুতু ফেলা যায় না। এটা একটা সামাজিক ভদ্রতার বিষয়। শিক্ষিত ছেলে, এটুকু আচরণের ভদ্রতা জানেন না?
মনে হলো ছেলেটি আমার দিকে তেড়েই আসবে। কি আশ্চর্য! যেই সামাজিক ভদ্রতা অন্য দেশে সহজাত ব্যাপার—সেটা আমাদের দেশে এতো কঠিন কেন বোঝানো?
তারপর মনে পড়ল, এদেশে এখনো খোলা আকাশের নিচে বহু মানুষ প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদন করেন। এমনকি, শৌচকর্মের পরে যে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হয় সেটাও মীনা কার্টুনের মাধ্যমে এদেশের মানুষকে শেখাতে হয়েছে এবং সেটা শেখাতেও কয়েক দশক লেগে গিয়েছিল। এখনো সবাই শিখেছে কি না কে জানে?
মরণ ব্যাধি থেকে মুক্তির জন্য একটা সামান্য মাস্ক পরার দায়িত্বটুকু নিতে পারছেন না অনেকে। অথচ, তাদেরকে বাঁচানোর জন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা দিনের দীর্ঘ সময় এন-৯৫ এর মতো শক্ত মাস্ক পরে থাকেন, পিপিই’র মতো কষ্টকর কাপড় পরে থাকেন—পানি পর্যন্ত পান করতে পারেন না দীর্ঘক্ষণ। এই মাস্ক না পরা দায়িত্বহীন মানুষগুলো নিজেদের স্বজনদেরও ঝুঁকিতে ফেলছেন প্রতিদিন—একবার ভাবছেন না তাদের কথাও।
মাস্ক পরা, যেখানে সেখানে থুতু না ফেলা, নাকে-মুখে হাত না দেয়া, হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার—এগুলো স্বাভাবিক সামাজিক সভ্য আচরণ। আফসোসের ব্যাপার এগুলো এখনো শেখাতে হয়। শেখানোর জন্য বাকবিতণ্ডা করতে হয়। এমন কি এই ভয়াবহ ছোঁয়াচে রোগের মহামারির সময়ও এই আচরণের শিক্ষাগুলো নিয়ে তর্ক করতে হয় মানুষজনের সাথে। সত্যিই অবাক করা ব্যাপার।
দৃশ্যপট: ১
স্থান: আমার চেম্বার
আমি: মাস্ক কই? মাস্ক নাই?
রোগী: আছে আপা। ব্যাগে।
আমি: মাস্ক পরেন নাই কেন?
রোগী: দম বন্ধ লাগে আপা।
আমি: আপনার না হয় প্রাণের ভয় নাই। আপনার থেকে আমার অন্য রোগীদের মাঝে যদি রোগ ছড়ায়, তাহলে দোষটা যে আপনার হবে, ভেবেছেন?
রোগী: আপা আমার করোনা হবে না। (ব্যাগ থেকে ছোট একটা কাগজ বের করে) এটা মহামারির দোয়া আপা। এটা সবসময় সাথে রাখি আর পড়ি। আমার করোনা হবে না।
আমি: দোয়ার সাথে দাওয়াও তো লাগে আপা। জীবাণু থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য মাস্ক পরতে হবে না? আর অন্য কারো যদি আপনার থেকে রোগটা ছড়ায়, আপনার পাপ হবে না?
মানুষের মাস্ক না পরার কত যে যুক্তি! গরম লাগে, দম বন্ধ লাগে, নেকাব পরেছি তো, সাথে আছে, পকেটে আছে। আরও কত যুক্তি। থুতনিতে ঝুলিয়ে রেখে ভাবছেন মাস্ক তো পরেছি। মুখের উপর থাকলেও নাক আর মুখ দুটোই ঢাকছেন খুব কম লোক। নাকটা খুলেই রাখছেন।
মরণ ব্যাধি থেকে মুক্তির জন্য একটা সামান্য মাস্ক পরার দায়িত্বটুকু নিতে পারছেন না অনেকে। অথচ, তাদেরকে বাঁচানোর জন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা দিনের দীর্ঘ সময় এন-৯৫ এর মতো শক্ত মাস্ক পরে থাকেন, পিপিই’র মতো কষ্টকর কাপড় পরে থাকেন—পানি পর্যন্ত পান করতে পারেন না দীর্ঘক্ষণ। এই মাস্ক না পরা দায়িত্বহীন মানুষগুলো নিজেদের স্বজনদেরও ঝুঁকিতে ফেলছেন প্রতিদিন—একবার ভাবছেন না তাদের কথাও।
করোনার প্রথম ধাক্কাটা কিছুটা কমার সাথে সাথেই সবাই যেন বাধাহীন উন্মত্ত হয়ে উঠলো। বাজার-সদাই, ঘোরাঘুরি, বিয়ে-শাদী, সমুদ্র সৈকতে ভেকেশন যেন জীবনের চেয়ে প্রিয় হয়ে দাঁড়ালো। কে বলবে বাঙালি ঘরকুনো জাতি? করোনার প্রকোপ একটু কমলো তো আমাদের ঘরে আটকে রাখে, সাধ্য আছে কার? চলে আসলো দ্বিতীয় ঢেউ। মৃত্যু ছাড়িয়েছে দশ হাজারের বেশি, এরা তো আমাদেরই স্বজন, তাই না? ঘটা করে বিয়ে-শাদী, শপিং, ঘোরাঘুরি কি সেই স্বজনের প্রাণের চেয়েও বেশি প্রয়োজন ছিল আমাদের?
জাতির জন্য, আশেপাশের মানুষের জন্য, আপনার বাড়ির প্রিয়জনের জন্য আমাদের এখন কোনো যুদ্ধে যাওয়ার জন্য আহ্বান করা হয়নি, জীবনপণ করে লড়তে বলা হয়নি। নিজের ও সকলের মঙ্গলের জন্য শুধু কিছু স্বাস্থ্যবিধি মানতে বলা হয়েছে—সেটুকুও যদি আমরা অভ্যাস করতে না পারি, এই দায়িত্ব যদি পালন করতে না পারি—তবে আমরা কেমন মানুষ?
প্রতিদিন শুনছেন করোনায় এতো জন মারা গেছেন, তাদের একেক জনের ফুসফুসের কত ভাগ নষ্ট ছিল—তাও মাঝে মাঝে জানতে পারছেন। গোটা পৃথিবীর বিশাল এই বায়ুমণ্ডলের এতো অক্সিজেন থাকা স্বত্বেও একটু শ্বাস নেওয়ার জন্য মৃত্যু পথযাত্রীর হাহাকার সামনে থেকে দেখেছেন কখনো? দেখলে বুঝবেন একটু শ্বাস নেওয়ার জন্য কী কষ্ট এই রোগীগুলোর। দেখলে আমাদের এই দায়িত্বহীন আচরণ যে কী ঝুঁকিপূর্ণ, অন্যায় ও অসভ্যতা—সেটা বুঝতে পারতেন।
যে জিনিসটা সবচেয়ে হতাশাজনক তা হলো, অন্যের ভালো-মন্দের ব্যাপারে আমাদের চরম উদাসীনতা। বারবার বলা হচ্ছে যে, কোনো লক্ষণ ছাড়াই আপনি করোনা পজিটিভ থাকতে পারেন। ফলে আপনি আপনার অজান্তেই আশে-পাশের সব মানুষের মধ্যে প্রতিটা শ্বাসের সাথে জীবাণু ছড়াতে থাকবেন। আপনি যদি মাস্ক পরেন অথবা হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার বজায় রাখেন—তাহলে সেই সংক্রমণের হারও কমে আসবে।
মাক্স না পরায় অন্য মানুষের মাঝে সংক্রমণ ছড়ানোর যে দায়, সেটা কি এই দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষগুলোর বিবেকে লাগে না? শুধু নিজের মঙ্গলের জন্য নয়, নিজের পরিবারের সুরক্ষার জন্য নয়, অন্য মানুষ যেন আক্রান্ত না হয়—সেই ভাবনাটুকু আমাদের মনে কেন আসে না? আমি যেন কারো ক্ষতির কারণ না হই, আমি যেন কারো মৃত্যুর উপলক্ষ না হই—সেটা কি যেকোনো বিবেকবান মানুষের মানসিকতা হওয়ার কথা নয়? যারা মাস্ক পরেন না, যেখানে সেখানে থুতু ফেলেন, হাঁচি বা কাশির সময় কনুই দিয়ে মুখ ঢাকেন না তাদের বলছি—এরপর যখন কোনো মৃত্যুর খবর পেপারে পড়বেন—জানবেন সেই মৃত্যুতে আপনারও কিছুটা দায় আছে। যে মানুষগুলো আজ অক্সিজেনের অভাবে ছটফট করছেন, সেই কষ্টের দায় পরোক্ষভাবে কিছুটা আপনারও বটে।
জাতির জন্য, আশেপাশের মানুষের জন্য, আপনার বাড়ির প্রিয়জনের জন্য আমাদের এখন কোনো যুদ্ধে যাওয়ার জন্য আহ্বান করা হয়নি, জীবনপণ করে লড়তে বলা হয়নি। নিজের ও সকলের মঙ্গলের জন্য শুধু কিছু স্বাস্থ্যবিধি মানতে বলা হয়েছে—সেটুকুও যদি আমরা অভ্যাস করতে না পারি, এই দায়িত্ব যদি পালন করতে না পারি—তবে আমরা কেমন মানুষ?
কোথায় আমাদের নাগরিক দায়িত্ববোধ, কোথায় আমাদের মানবিকতা? নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করলেই উত্তর জানা যাবে। মনে রাখবেন, কোভিড-১৯ নামক করোনাভাইরাসের মহামারি কেটে গেলেও, এই জীবাণু, এই রোগ সহসা চলে যাবে না। সুতরাং, এর থেকে সুরক্ষিত থাকার জন্য স্বাস্থ্যবিধিগুলো জীবনাচরণের অংশ করে অভ্যাসে পরিণত করে ফেলাই আপনার ও আপনার আশেপাশের সকলের জন্য মঙ্গলজনক।
ডা. নুজহাত চৌধুরী । অধ্যাপক, চক্ষু বিজ্ঞান বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post