ডাঃ মোঃ কামরুজ্জামান, এমবিবিএস, এফসিপিএস
জন্ডিস (Jaundice) শব্দটি ফরাসি শব্দ যার অর্থ হলুদাভ। জন্ডিস আসলে কোন রোগ নয়, এটি রোগের লক্ষণ মাত্র।
জন্ডিস তিন প্রকার :
১). হিমোলাইটিক জন্ডিস (প্রিহেপাটিক)
২). হেপাটোসেলুলার জন্ডিস (হেপাটিক) ও
৩). অবস্ট্রাক্টিভ জন্ডিস (পোস্টহেপাটিক)।
যে কারনে জন্ডিস দেখা দেয়
কোন কারনে অপরিপক্ক/পরিপক্ক লোহিত রক্ত কণিকা বেশি বেশি ভেংগে গেলে যে জন্ডিস দেখা দেয় তাকে হিমোলাইটিক জন্ডিস বলে। থ্যালাসেমিয়া, ইমিউন হিমোলাইটিক এনেমিয়া, ইনফেকশন ছাড়াও অন্যান্য কারনে হিমোলাইটিক এনেমিয়া হতে পারে। এক্ষেত্রে একজন হেমাটোলজিষ্ট বা রক্তরোগ মেডিসিন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হয়।
লিভারের সমস্যার কারনে যে জন্ডিস হয় তাকে হেপাটোসেলুলার জন্ডিস বলে। হেপাটাইটিস এ, ই, বি, সি ভাইরাস, নির্দিষ্ট কিছু ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, হোমিওপ্যাথি, কবিরাজী, আয়ুর্বেদ, ভেযজ ঔষধি, মদ ও নেশা জাতীয় দ্রব্য ছাড়াও অন্যান্য কারনে হেপাটোসেলুলার জন্ডিস হতে পারে। এক্ষেত্রে একজন গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিষ্ট বা লিভার বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হয়।
লিভার থেকে পিত্তরস তৈরি হয়ে পিত্তথলিতে জমা থাকে এবং পরবর্তীতে পিত্তনালীর মাধ্যমে পৌষ্টিকতন্ত্রে যায় যা খাদ্য হজম করতে সাহায্য করে। পিত্তরসের এই বিলিরুবিন পায়খানার সাথে শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। বিলিরুবিনের দীর্ঘ পথ পরিক্রমা স্বাভাবিকভাবে না হয়ে যে কোনো অসঙ্গতি দেখা দিলে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যায় এবং যে জন্ডিস দেখা দেয় তাকে অবস্ট্রাক্টিভ জন্ডিস বলে।
পিত্তথলি, পিত্তনালী ও অগ্নাশয়ে পাথর, টিউমার ইত্যাদি কারনে এই জন্ডিস হয়। এক্ষেত্রে সার্জারি বা গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিষ্ট বা লিভার বিশেষজ্ঞের মতামত নিতে হয়।
রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে গেলে জন্ডিস দেখা দেয়। তাই চোখের সাদা অংশ, ত্বক এবং অন্যন্য মিউকাস ঝিল্লি হলুদ হয়ে যায়।
বিলিরুবিন পিত্তরসের একটি উপাদান। মানুষের রক্তে বিলিরুবিনের ঘনত্ব সাধারণত ১.২ মিঃগ্রা/ডিএল বা ২৫ মাইক্রোমোল/লিঃ এর নিচে থাকে। এর বেশি হলে জন্ডিস হয়।
জন্ডিসের লক্ষণ ও উপসর্গসমূহ :
১). চোখ ও প্রসাবের রং হলুদ হয়ে যাওয়া আবার সমস্যা বেশি হলে পুরো শরীর গাঢ় হলুদবর্ণ ধারণ করতে পারে।
২). শারীরিক দুর্বলতা।
৩). ক্ষুধামন্দা।
৪). জ্বর জ্বর অনুভূতি কিংবা কাঁপানি দিয়ে জ্বর আসা।
৫). বমি বমি ভাব অথবা বমি।
৬). মৃদু বা তীব্র পেট ব্যথা।
৭). অনেকসময় পায়খানা সাদা হয়ে যাওয়া।
৮). চুলকানি।
৯). লিভার বা যকৃত, প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া।
কি কি পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে-
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রক্তের সিবিসি, ব্লাড ফিল্ম, রেটিকুলোসাইট, বিলিরুবিন (ডাইরেক্ট ও ইনডাইরেক্ট), লিভার এনজাইম, পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাফি ইত্যাদি পরীক্ষা করাতে হয়।
জন্ডিসের চিকিৎসা কি?
সব জন্ডিসের রোগীর চিকিৎসা এক নয়। জন্ডিসের প্রকারভেদ অনুযায়ী চিকিৎসাও ভিন্ন। তাই রেজিস্ট্রার্ড চিকিৎসক ছাড়া জন্ডিসের চিকিৎসা নয়।
সচেতনতা :
আমাদের দেশে আখের রস জন্ডিসের একটি বহুল প্রচলিত ওষুধ। অথচ রাস্তার পাশের যে দূষিত পানিতে আখ ভিজিয়ে রাখা হয় সেই পানি মিশ্রিত আখের রস খেলে হেপাটাইটিস এ বা হেপাটাইটিস ই ভাইরাস মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পরতে পারে।
আমাদের দেশের একটি প্রচলিত বিশ্বাস হচ্ছে জন্ডিসের রোগীকে হলুদ দিয়ে রান্না করা তরকারি খাওয়ানো যাবে না কারন এতে রোগীর জন্ডিস আরও বাড়তে পারে। রক্তে বিলিরুবিন নামক একটি হলুদ পিগমেন্টের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারনেই জন্ডিস দেখা দেয়। এর সাথে হলুদের কোন সম্পর্ক নেই।
একইভাবে জন্ডিসের রোগীকে তেল-মসলা না দিয়ে শুধুমাত্র সিদ্ধ করা খাবার খেতে দেয়াও ঠিক নয়। এ সমস্ত রোগীদের এমনিতেই খাবারে অরুচি থাকে তার উপর এ ধরণের খাবার রোগীদের উপকারের চেয়ে অপকারই বেশী করে। তাই জন্ডিসের রোগীকে সব সময় এমন খাবার দেয়া উচিত যা সহজে হজম হয় এবং রোগী খেতে পছন্দ করেন। তবে অবশ্যই বাইরের খাবার সব সময় পরিহার করতে হবে।
বিশেষ করে পানির ক্ষেত্রে একটু বেশি সাবধানে থাকতে হবে। জন্ডিস থাক বা না থাক, সব সময়েই বিশুদ্ধ পানি বা ফুটিয়ে পানি পান করা উচিত।
বাহিরে থেকে আনা ফুচকা, চটপটি, বোরহানি আর সালাদের ব্যাপারে খুব সাবধান থাকতে হবে।
সহকারী অধ্যাপক (হেমাটোলজি), সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
Discussion about this post