বয়স বাড়ার সাঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য শারীরিক নানা উপসর্গের সাথে সাথে প্রস্রাবের সমস্যাও এসে হাজির হয়। এসময়পুরুষ ও মহিলা উভয়েই এই সমস্যায় পড়েন এবং গোপন করতে চেষ্টা করেন।
সমস্যাটা যেহেতু প্রস্রাবজনিত এবং অনেক সময় কাপড়-চোপড়ে হয়ে যায়, বারবার প্রস্রাব করতে যাওয়া সমস্যাটা তখন আর একান্ত ব্যক্তিগত থাকে না। বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে অনেকেই মানসিক বিষাদের শিকার হয়ে পড়েন।
বার্ধক্যে প্রস্রাব সংক্রান্ত এই ধরনের সমস্যায় পুরুষ ও মহিলাদের ক্ষেত্রে কারণ ভিন্ন থাকলেও সমস্যাটা কিন্তু উভয়েরই আসে।
পুরুষদের প্রস্টেট গ্ল্যান্ড বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বড় হতে থাকে এবং সেটা যখন প্রস্রাবের রাস্তা কিছুটা বা পুরোপুরি বন্ধ করে দেয় তখনই সমস্যা তৈরি হয়। তবে প্রস্টেট যে বাড়ে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এটা কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়মে স্বাভাবিক ভাবেই হয়। মানুষের চুল যেমন পাকতে থাকে প্রস্টেটও ঠিক তেমনি বড় হয়। তবে প্রস্টেট বড় হলেই যে সমস্যা তৈরি করবে তা কিন্তু নয়। অনেকেরই বড় হয় কিন্তু কোনো অসুবিধের লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায় না। আবার অনেকের বড় না হয়েও খুবই সমস্যা তৈরি করে, কষ্ট হয়। সমস্যাটা দেখতে হবে প্রস্রাবের রাস্তা কতখানি ব্লক করছে আর প্রস্রাবের থলির সঙ্গে তার কো-অর্ডিনেশনটা কতখানি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
এটা জানতে গেলে প্রথমে রোগীর সাথে কথা বলতে হবে। তারপরে কয়েকটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেই বোঝা যাবে প্রস্রাবের ঠিক কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে।
একটা আলট্রাসোনোগ্রাফি করতেই হয়। আর ব্লাড টেস্টটা জরুরি, রোগীর ডায়াবেটিস আছে কি না তাহলে জানা যাবে। এবং প্রস্টেট বড় হওয়ার পেছনে বিনাইন বা ম্যালিগন্যান্ট আছে কি না জানা যাবে পি.এস.এ পরীক্ষার মাধ্যমে। কারণ ছেলেদের ক্ষেত্রে ক্যানসারে মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ প্রস্টেট ক্যানসার। আর প্রথমটা অবশ্যই লাং ক্যানসার।
বিনাইন প্রস্টেট হলে শুধু ওষুধেই এর অনেক ভালো চিকিৎসা আছে। সুতরাং প্রস্টেট বড় হয়েছে, অবস্ট্রাকশন বা প্রস্রাবে বাধা আসছে বলেই যে অপারেশন করতে হবে এমন কিন্তু নয়।
অনেক ওষুধ এসেছে বাজারে যেগুলোর ব্যবহারে রোগী অনেক রিলিফ বোধ করে। আজকাল এমন সব কার্যকরী ওষুধ এসেছে যেগুলো সারা জীবন যদি রোগী খেয়ে যায় তাহলে আর কোনো অসুবিধেই হবে না। তবে এটা তখনই সম্ভব যখন রোগী সমস্যার শুরতেই ডাক্তারের কাছে পৌঁছে যায়। কিন্তু যদি অবস্ট্রাকশন খুব বেশি হয় এবং কমপ্লিকেশন বেড়ে যায় যেমন প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া, ব্লিডিং হওয়া, বারবার প্রস্রাব এইসব জটিলতাগুলো যদি খুব বেশি বেড়ে যায়, তখন আর অপারেশন ছাড়া উপায় থাকে না।
কিন্তু রোগী বুঝবে কী করে রোগের প্রাথমিক পর্যায়?
প্রথম লক্ষণ হচ্ছে রাতে বার বার উঠে প্রস্রাব করতে যাওয়া এবং প্রস্রাব পুরোপুরি বেরিয়ে না আসা। প্রস্রাবে গন্ধ থাকতে পারে যখন সেটা জমে যায় ব্লাডারে। তাই যখনই দেখবেন বারবার প্রস্রাব হচ্ছে, প্রস্রাব করার পর সন্তুষ্টি আসছে না তখনই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। রোগী যে অসুবিধের কথা বলছে তার সাথে পরীক্ষিত প্রস্রাবের রিপোর্টটাকে মেলোতে হবে। তখনই একটা সিদ্ধান্তে আসা যায় রোগীকে মেডিসিন দিয়ে চিকিৎসা করা হবে নাকি সার্জারি করা হবে।
ওষুধে যদি একবার কাজ করতে শুরু করে তাহলে ওই ওষুধ চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে জীবন ভর। ঠিক ডায়াবেটিসের মতো। সারাজীবন খেতে হবে। দু’দিন ওষুধ খেয়ে ভালো হয়ে যাবে এমন ভাবার কারণে নেই।
সুতরাং প্রথম দিকে ডাক্তার দেখালে ওষুধেই কাজ হবে। আজকাল প্রায় শতকরা সত্তর ভাগ লোকের অপারেশন লাগে না শুধু রোগের শুরুতেই আসার কারণে।
যখন জটিলতা বেড়ে যায়, রক্তপাত, প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি দেখা দেয় তখনই অপারেশনের দরকার হয়।
বার্ধক্যের আর একটি সমস্যা ব্লিডিং।
প্রস্রাবের রাস্তায় রক্তক্ষরণ অনেক কারণ হতে পারে। কিডনির কারণে হতে পারে, স্টোন বা টিউমার থেকে হতে পারে,ব্লাডারের জন্য হতে পারে, ব্লাডারে স্টোন বা টিউমার থাকতে পারে। স্টোন হলে সাধারণত ব্যথা হবেই। কিন্তু টিউমারে ব্যথা নাও হতে পারে। প্রস্রাবের পথে রক্ত বেরোনে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এটা রোগীকে অ্যালার্ম দিচ্ছে ভাবতে হবে। বিলোলাই সংক্রমণ হয়েছে ভেবে বসে থাকা একদম উচিত নয়। অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
মেয়েদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা।
মেয়েদের পিরিয়ডটা শেষ হয়ে যাওয়ার সময় অর্থাৎ মেনোপজ আসতে শুরু করে তখন পুরো শরীরে একটা হরমোনাল পরিবর্তন আসে। যেটার জন্য ব্লাডারের পরিবর্তন হয়, প্রস্রাবের রাস্তায় পরিবর্তন হয় এবং ভ্যাজাইনাতেও পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তনের জন্য বারবার প্রসাব করতে যাওয়া, প্রস্রাব ধরে রাখতে না পারা, প্রস্রাব আপনা থেকেই হয়ে যাওয়া যাকে ইনকন্টিনেন্ট বলে ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। মেয়েদের প্রস্রাবের রাস্তায় অবস্ট্রাকশন খুব কম হয়। সাধারণত মেয়েরা সমস্যাগুলো লুকিয়ে রাখে, বলতে লজ্জা পায়। অথচ চিকিৎসা করলে এটা একদম ভালো হয়ে যায়। আমাদের আসলে ভালো করে জেনে নেওয়া উচিত সত্যিই কি কোনো সমস্যা হয়েছে? অনেকের একট ভুল ধারণা আছে যে মেয়েদের একটা সন্তান হলেই রেকারেন্ট ইউ.টি.আই হয়। বাস্তবে কারণটা খুঁজতে হবে কেন বার বার সংক্রমণ হচ্ছে। সেটা না করে খালি বিকোলাই হয়েছে বলে দিনের পর দিন অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে যাওয়া কোনো মানে নেই।
পোস্ট মেনোপজ বা পেরিমেনোপজ বা বার্ধক্যে ইউরিন পরীক্ষা করে যদি দেখা হয় কোনো সংক্রমণ নেই অথচ বারবার প্রসাব, বেগ সামলাতে না পারা ইত্যাদি সমস্যা রয়েছে এ-সব তখন ভাবতে হবে হরমোনাল ডিসব্যালেন্সের জন্যই হচ্ছে।
আজকাল আর একটা জিনিস খুব দেখা যাচ্ছে সেটা হল ভিটামিন-ডি ডেফিসিয়েন্সি, ক্যালসিয়াম ডেভিসিয়েন্সি।
এমনিতে মেয়েদের অবস্ট্রাকশন হওয়ার কথা নয়। অবস্ট্রাকশন যদি থাকেও তাদের হরমোনাল চিকিৎসা, ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন-ডি’র ব্যবহারে শতকরা নিরানব্বই ভাগ ক্ষেত্রে উপকার পাওয়া যায়। তাই মেয়েদের অবস্ট্রাকশন থাকলে এই চিকিৎসাগুলে আগে করা উচিত।
যদি প্রস্রাবের সাথে রক্ত কখনো আসে তাহলে কিন্তু স্টোন এবং টিউমারের কথা ভাবতে হবে। যাদের আগেই কোনো কারণে ইউটেরাস বাদ চলে গেছে তাদের কিন্তু হরমোনাল ডেফিসিয়েন্সি হবেই। তাই হরমোনাল রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি দিতে হবে। বারবার প্রস্রাবে সংক্রমণ হলে অবস্ট্রাকশনের কথা ভেবে চিকিৎসা করা দরকার। লুকিয়ে রেখে শারীরিক ও মানসিক কষ্ট সহ্য করার কোনো মানেই হয় না।
Discussion about this post