হার্টবিট ডেস্ক
মা হতে চলেছেন? সামনে প্রচুর দায়িত্ব, লড়াই আর অনেকটা ভালোলাগা অপেক্ষা করে আছে আপনার জন্য। মানসিক প্রস্তুতি তো নিতে শুরু করেছেন, শারীরিক দিক থেকেও আপনি প্রস্তুত তো? হ্যাঁ, একজন হবু মা কে শারীরিক এবং মানসিক দুই দিকেই প্রস্তুত হতে হয় নিজের স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য, যে অতিথিটি আসতে চলেছে তাকে মানুষ করার জন্য এবং সেই পুঁচকে অতিথির সুস্বাস্থ্যেরও জন্যও বটে! একজন হবু মায়ের পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং সুষম খাবার খাওয়ার অভ্যাস যে মা ও গর্ভস্থ সন্তান, দুইয়ের জন্যই কতটা জরুরি,তা কারও অজানা নয়। এসময় মায়ের শরীর থেকেই শিশু পুষ্টি পায় ও ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে। তাই গর্ভস্থ শিশুটিকে পর্যাপ্ত পুষ্টির জোগান দিতেও হবু মাকে বিশেষ নজর দিতে হয় খাদ্যচর্চায়।
অনেকের মধ্যে একটা অজ্ঞানতা বা কুসংস্কার কাজ করে যে, হবু মাকে বেশি খাবার খাওয়ালে গর্ভের সন্তান অনেক বড় হয়ে যাবে এবং স্বাভাবিক প্রসবে অসুবিধা হবে। এই ধারণা কিন্তু একেবারেই ভুল। বেশি খাবার খাওয়া এবং সম্পূর্ণ পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার মধ্যে কিন্তু আসমান-জমিন পার্থক্য। গর্ভাবস্থায় শরীরে অতিরিক্ত ক্যালোরির প্রয়োজন হয় এবং স্বাভাবিক ওজনের একজন হবু মাকে ১১ কেজি ওজন বাড়াতে হয়।
যেসব মায়েদের ওজন তুলনামূলক বেশি, তাদের কম ওজন বাড়ালেও চলে। মোদ্দা কথা, শিশুর বৃদ্ধিতে যেরকম প্রয়োজন, সেই অনুযায়ী মায়ের ওজন বাড়াতে বলেন ডাক্তাররা। আর এই ওজন বৃদ্ধি যা হোক খেয়ে বা তেলমশলায় কষানো রান্না খেয়ে একেবারেই করা উচিত না, সেটা আশা করি বুঝতেই পারছেন। হবু মা এবং গর্ভের সন্তান, দু’জনেই সম্পূর্ণ পুষ্টি পাবে এরকম খাবারই খাওয়া উচিত এবং নির্দিষ্ট পরিমাণে। খুব কমও না, খুব বেশিও না। হবু মায়ের খাদ্যতালিকায় কী কী খাবার রাখতেই হবে, তার একটা খসড়া ছকে দিচ্ছি আমরা।
হবু মায়ের খাদ্যাভ্যাসের ওপর কী কী নির্ভরশীল (Why a good diet is necessary for pregnant women)
- হবু মায়ের শরীর ভালো রাখা।
- হবু মায়ের যাতে রক্তাল্পতা না হয়।
- অপুষ্টি জনিত কোনও শারীরিক রোগে যাতে মা বা সন্তান আক্রান্ত না হয়।
- গর্ভের সন্তানের সঠিক বিকাশ।
- সুস্থ সন্তান প্রসবে মাকে সাহায্য করা।
- বাচ্চার জন্মের পর পর্যাপ্ত পরিমাণে বুকের দুধ তৈরি হওয়া।
খাদ্যতালিকায় রাখতেই হবে যেসব খাবার (What To Eat During Pregnancy – Must Haves)
#1. দুধ ও দুগ্ধজাত পদার্থ (Dairy products)
লো ফ্যাট গোরুর দুধে থাকা ক্যালসিয়াম, প্রোটিন, ভিটামিন-A এবং ম্যাগনেসিয়াম যেমন গর্ভের শিশুর হাড়ের কাঠামো তৈরিতে সাহায্য করে, তেমনই আপনার হাড়, দাঁতের স্বাস্থ্যও মজবুত করে। তাই নিয়মিত দুধ বা দুগ্ধজাত দ্রব্য যেমন পনির, দই, বাটারমিল্ক রাখতেই হবে হবু মায়ের খাদ্যতালিকায়।
#2. তাজা ফল এবং শাকসবজি (Fresh fruits and green leafy veggies)
সবুজ শাকসবজি এবং ব্রকলি ফলিক অ্যাসিডের অন্যতম উৎস। সবুজ শাকসবজিতে থাকে ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম এবং আয়রনও।পালং শাক হবু মাকে পর্যাপ্ত আয়রন এবং ফলিক অ্যাসিডের জোগান দেয়। প্রেগন্যান্সিতে সবুজ শাকসবজি হবু মায়ের প্রয়োজনীয় মিনারেলসের চাহিদাও পূরণ করে। মটরশুঁটি এবং টম্যাটো খাওয়াও এসময় ভালো।
এছাড়া, তাজা ও মরসুমি ফল খেতে হবে রোজ। ফলের মধ্যে কলা খাওয়া এই সময় বেশ ভালো। কলায় আছে ফাইবার, ভিটামিন এবং পটাশিয়াম। শরীরে এনার্জির জোগান দেয় কলা। প্রেগন্যান্সিতে তরমুজ খেলে মর্নিং সিকনেস কমে আবার শরীর আর্দ্র থাকে। শরীরকে ভিটামিন সি দিতে খেতে হবে আম, কমলালেবু এবং পাতিলেবুর মতো ফল। এইসব ফল ও সবজি যে শুধু হবু মায়ের শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে তাই নয়, এর ফাইবার হবু মাকে মুক্তি দেয় কোষ্ঠকাঠিন্যের হাত থেকে।
#3. আমিষ খাবার (Egg, fish, chicken)
আমিষ খাবার বলতে আমরা ডিম, মাছ ও মাংসই বুঝি। ডিমকে প্রোটিনের ভাণ্ডার বললে ভুল কিছু বলা হয় না। ডিমের মধ্যে উপস্থিত উচ্চমানের প্রোটিন, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড,আয়রন এবং কোলিন অ্যামনিওটিক মেমব্রেন্সকে শক্তিশালী করে। গর্ভের সন্তানের পূর্ণ বিকাশেও সাহায্য করে ডিম। আমিষ খাবারের প্রোটিন মায়ের স্তন কোষের সংখ্যা বাড়াতে সাহায্য করে। কলিজায় থাকে আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড। প্রাণীজ প্রোটিনের আরেক অন্যতম উৎস মুরগীর মাংস। মুরগীর মাংসের স্যুপ বা কম তেলমশলা দেওয়া মুরগীর ঝোল, গর্ভাবস্থায় শুধু মুখরোচকই নয়, স্বাস্থ্যকরও বটে। হবু মায়ের শরীরে পর্যাপ্ত প্রোটিন গেলে মা ক্লান্তি থেকে মুক্তি পায়। শিশুর পেশী এবং কোষ গঠনে সাহায্য করে এই প্রাণীজ প্রোটিন। মাছেও রয়েছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এবং ভালো মানের প্রোটিন; যা শিশুর চোখ ও মস্তিষ্কের বিকাশে সাহায্য করে। মিষ্টি জলের মাছ রোজ থাকুক পাতে। তবে গর্ভাবস্থায় সামুদ্রিক মাছ খুব ভালো করে রান্না করে তবেই খান।
#4. ডাল ও দানা শস্য (Pulses and legumes)
উদ্ভিজ প্রোটিনের অন্যতম উৎস হল ডাল, বিন্স, অঙ্কুরিত ছোলা, অঙ্কুরিত মুগ ইত্যাদি। হবু মায়ের শরীরে উদ্ভিজ প্রোটিন, ফাইবার, ভিটামিন B 12, ফোলেট, আয়রন এবং জিঙ্কের মতো পরিপোষকের জোগান দেয় এরা। মা এবং বাচ্চার উভয়েরই স্বাস্থ্য ভালো রাখে এইসব দানা শস্য এবং ডাল। ডালের মধ্যে মুগ ডাল, মুসুরি ডাল বা কলাইয়ের ডাল নিয়মিত রাখুন আপনার খাদ্যতালিকায়।
#5. ড্রাই ফ্রুটস ও বাদাম (Dry fruits and nuts)
শরীরে প্রোটিন ও এনার্জির জোগান দেবে এরাই। লিস্টে রাখুন আমন্ড, পেস্তা, ওয়ালনাট, অ্যাপ্রিকট এবং খেজুর। ওমেগা-৬,ওমেগা-৩ এর মতো প্রয়োজনীয় ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিন,আয়রন, জিঙ্ক, সেলেনিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি পরিপোষককে হবু মায়ের শরীরে ঢুকিয়ে দেবে ড্রাই ফ্রুটস ও বাদাম । বিকেল বেলা একমুঠো খেতেই পারেন কুড়মুড়িয়ে। তবে বাদাম হতে হবে নুন ছাড়া।
#6. ওটস (Oats)
ওটস ভরপুর ভিটামিন, ফাইবার এবং এনার্জিতে। ওটসের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (glycaemic index (GI)) কম হওয়ার কারণে ওটস খেলে পেট অনেকক্ষণ ভর্তি থাকে এবং প্রয়োজনীয় এনার্জিও পাওয়া যায়। স্মুদি বা পায়েস বানিয়ে খেতেই পারেন।
#7. ভাত, আটার রুটি (Rice, roti)
খেতে হবে শর্করা জাতীয় খাবার বা কার্বোহাইড্রেটও। তবে অতিরিক্ত খাবেন না। প্রতিদিনের ভাত, রুটি, মুড়ি, চিঁড়ে, খই রাখুন আপনার খাদ্যতালিকায়। আলু, চিনি, গুড় ইত্যাদিও খান তবে নির্দিষ্ট পরিমাণে।
কোনটা কখন খাবেন (What To Eat During Pregnancy – Diet chart)
উপরোক্ত খাবারগুলি ছাড়াও, সামান্য ফ্যাট জাতীয় খাবার হবু মায়ের খাওয়া উচিত। ফ্যাট বাচ্চার বিকাশেও সাহায্য করে আবার মায়ের শরীরকে প্রসবের জন্য প্রস্তুত করে। তবে আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট খাওয়াই ভালো। আবার প্রত্যেকের শরীর বা প্রেগন্যান্সির ধরন আলাদা হয়, তাই একজন ডায়েশিয়ানের সাথে পরামর্শ করেই খাদ্যতালিকা বানানো উচিত। হবু মায়েরা কখন কী খাবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খেতে পারেন, আমরা তার একটা সাধারণ চার্ট তৈরি করে দিলাম।
সবশেষে হবু মায়েদের বলি, নিজের যত্ন নিন এবং সময় ধরে খাওয়া দাওয়া করুন। মনে রাখবেন, আপনি কিন্তু এখন দুজনের হয়ে একা খাচ্ছেন, তাই দুজনের পুষ্টির ভারই আপনার ওপর বর্তায়। যেহেতু সবার শরীর আলাদা এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুষ্টিগত দিক থেকেও তাদের চাহিদা আলাদা হয়ে থাকে, তাই কনসিভ করার পরে একজন ডায়েটিশিয়ানের সাথে কথা বলে নিন। কোনও খাবার খেয়ে গ্যাস বা অম্বল হচ্ছে কি না, সেদিকে খেয়াল রাখুন। আপনাকে যদি কোনও ভিটামিন ওষুধ বা সাপ্লিমেনট দিতে হয়, সেটা আপনার ডাক্তার দেবেন। আপনি নিজে নিজে কোনও ওষুধ কিনে খাবেন না। গর্ভাবস্থায় কিছু কিছু ফল যেমন আনারস, পেঁপে খাওয়া ভালো নয়। সামুদ্রিক মাছ যেমন চিংড়ি খেলে খুব ভালো করে রান্না করবেন। সুস্থ থাকুন, পেট ভরে খান, মাতৃত্বের প্রথম ধাপ চুটিয়ে অনুভব করুন।
Discussion about this post