হার্টবিট ডেস্ক
নারী জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর বিষয় হচ্ছে মা হওয়ার অনুভূতি। সন্তান ধারণের এই দশ মাস গর্ভবতী মা’র জীবনে আসে ব্যাপক পরিবর্তন। গর্ভধারণের পুরো সময়কে তিনভাগে ভাগ করা যায়- প্রথম ট্রাইমিস্টার (Trimester), দ্বিতীয় ট্রাইমিস্টার এবং তৃতীয় ট্রাইমিষ্টার। যারা প্রথমবার মা হয়, গর্ভধারণের পর এক-দুই মাস তারা অনেক সময় বুঝতেই পারেন না যে তারা প্রেগন্যান্ট। সন্তানের সুরক্ষার জন্য গর্ভধারণের প্রথম তিন মাস গর্ভবতী মায়েদের সতর্ক থাকা অত্যন্ত জরুরি।
পরিমিত পরিমাণ পানি পান
গর্ভাবস্থায় মহিলারা প্রায়শই ডিহাইড্রেটেড হয়ে যান। পর্যাপ্ত পরিমাণ পান পান করে, আপনি কেবল ডিহাইড্রেশনই প্রতিরোধ করছেন না, পাশাপাশি মূত্রনালীর সংক্রমণের ঝুঁকিও হ্রাস করছেন।
ডায়েট
আপনার ডায়েটে ফলিক অ্যাসিড বাধ্যতামূলক করুন। ফলিক এসিড আপনার গর্ভের সন্তানের স্নায়ুর বিকাশে সাহায্য করে। খাওয়া এবং ব্যায়ামের মধ্যে একটি ভাল ভারসাম্য বজায় রাখুন। কেগেল ব্যায়াম করার জন্য নিয়মিত সময় দিন। কেগেল পেশী যোনি অঞ্চলে থাকে যা আপনাকে আপনার মূত্রত্যাগ এবং অন্যান্য গতিবিধি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এতে গর্ভকালীন ব্যথা থেকেও মুক্তি পাবেন। এসময় হালকা কাজ করলে ক্ষতি হবে না। তবে ভারী কোনো কাজ করা থেকে বিরত থাকুন।
ভ্রমণে সতর্কতা
ভ্রমণ করার সময় খুব বেশি সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার। অল্প দূরত্বের ভ্রমণ বা দূরের সফরে যাওয়া, যাই হোক না কেন, আপনার যাত্রা শুরু করার আগে আপনার কাছে প্রয়োজনীয় সমস্ত ওষুধ এবং গিয়ার রয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করুন।
পর্যাপ্ত বিশ্রাম
দুপুরে খাওয়ার পর ন্যাপ বা হালকা ঘুমিয়ে নিন। এতে আপনার শরীরে প্রয়োজনীয় শক্তি সঞ্চয় হবে।
গর্ভাবস্থাকে স্মরণীয় করুন
একটি ছোট ডায়েরি লেখা শুরু করুন। প্রতিদিন আপনি কি করেছেন এবং কেমন অনুভব করেছেন-তা লিখুন।
ডাক্তারি পরামর্শ
কোন ব্যথা বা যন্ত্রণা অথবা জ্বরের ক্ষেত্রে প্রথমে আপনার ডাক্তারকে যোগাযোগ করুন। চিকিৎসকের সাথে কথা বলার আগে কোন ওষুধ, এমনকি মলম বা লোশনও ব্যবহার করবেন না।
বিশেষ রোগ-প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
এ সময় নিয়মিত সাবান দিয়ে ভালোভাবে গোসল করুন এবং হাত-পায়ের নখ কেটে ছোট করে রাখুন। গর্ভকালে মায়েদের দাঁতগুলো বেশ নরম হয়ে যায়, তাই দাঁত ও মাড়ির বিশেষ যত্ন নিতে হবে।
পিচ্ছিল স্থানে হাঁটা যাবে না এবং সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। গর্ভবতী মায়েদের অবশ্যই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, আরামদায়ক, সহজে পরিধানযোগ্য ও ঢিলেঢালা পোশাক পরা উচিৎ। সঠিক মাপের এবং নরম জুতো পরুন।
গর্ভাবস্থায় রক্তপাত এবং সমাধান
রক্তপাত ঘটার পর চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে প্রথমে আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হয়। এর মাধ্যমে গর্ভস্থ সন্তান জীবিত নাকি মৃত সেটা জানা যাবে। জীবিত সন্তান গর্ভে থাকার পরও রক্তপাত হতে পারে, যাকে বলে ‘থ্রেটেন্ড মিসক্যারেজ’। এসব ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা দিয়ে রক্তপাত বন্ধ করা যায় এবং সুস্থ শিশু ভূমিষ্ঠ করা যায়। আল্ট্রাসনোগ্রাম ছাড়াও রক্ত পরীক্ষা করে দেখা হয় গর্ভস্থ সন্তান সুস্থ রয়েছে কি না।
অনেক সময় আঘাত বা পানি বেশি থাকার কারণে প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল সময়ের আগেই জরায়ু থেকে সরে আসে। এটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ, যাকে ‘প্লাসেন্টাল অ্যাবরাপশন’ বলা হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে গর্ভফুল জরায়ুর মুখের ওপর বা জরায়ু মুখের খুব কাছাকাছি ইমপ্লান্টেড হয়ে থাকে। ওই সময় এসব রোগীকে হাই রিস্ক প্রেগন্যান্সির রোগী হিসেবে শনাক্ত করে চিকিৎসা করা হয়। নিরাপদ ডেলিভারির জন্য আগে থেকে তিন থেকে চারজন রক্তদাতা রেডি করে রাখুন।
গর্ভাবস্থায় রক্তপাত এড়াতে-:
❏ গর্ভাবস্থায় পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে।
❏ ভারী কাজ করা যাবে না।
❏ দুশ্চিন্তামুক্ত ও সদা হাসিখুশি থাকতে হবে।
❏ তলপেটে আঘাত, চাপ লাগা বা এমন কোনো কাজ করা যাবে না।
❏ দূরবর্তী স্থানে বা ঝুঁকিপূর্ণ ভ্রমণ করা যাবে না।
❏ সহবাস থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়।
❏ থাইরয়েড, ডায়াবেটিস, ইনফেকশন ইত্যাদি থাকলে তার চিকিৎসা নিতে হবে।
❏ নিয়মিত চেকআপ করাতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে।
পা ফোলা প্রতিরোধে করণীয়:
গর্ভাবস্থায় আপনার শরীর বাড়তি তরল তৈরি করে এবং কখনো কখনো আপনার পা এবং পায়ের পাতায় এই তরল জমা হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়৷
ফোলাভাবের উপশম করতে, দিনের বেলায় কিছুক্ষণ পা উপরদিকে তুলে রেখে বিশ্রাম করার চেষ্টা করুন৷ অনেকক্ষণ ধরে একভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে ফোলাভাব বেড়ে যেতে পারে। তাই কিছু কিছু কাজ বসে করার চেষ্টা করুন৷
শুতে যাওয়ার এক ঘন্টা আগে থেকে কোনো তরল না খাওয়ার চেষ্টা করুন৷ হাঁটু দুটির মাঝখানে বালিশ বা কাপড়ের প্যাড রেখে বাঁ পাশ ফিরে ঘুমোন৷
গর্ভবতী মায়ের ওজন
মায়ের স্বাস্থ্যকর ওজন—মা আর শিশু দুজনের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভবতী মায়ের ওজন প্রয়োজনের তুলনায় কম হলে গর্ভের শিশুর বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়, শিশুর ওজন কম হয়। এ ছাড়া গর্ভকাল পূর্ণ হওয়ার আগেই সন্তানের জন্ম হয়ে যাবার ঝুঁকি থাকে মায়ের ওজন কম থাকলে। কম ওজন নিয়ে কিংবা পূর্ণ গর্ভকাল পেরোনোর আগে জন্মানো শিশুর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা স্বাভাবিক শিশুদের চেয়ে কম হয়। নানান জটিলতায় ভোগে এই শিশুরা।
অন্যদিকে মায়ের ওজন প্রয়োজনের তুলনায় বেশি বেড়ে গেলে গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন জটিলতা বাড়ে। মায়ের উচ্চ রক্তচাপ, প্রি-একলাম্পসিয়া, একলাম্পসিয়া ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। গর্ভস্থ শিশু অত্যধিক বড় হয়ে যেতে পারে, প্রসবের সময় শিশু বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে (অবস্ট্রাক্টেড লেবার), প্রসব হতে খুব বেশি সময় লাগতে পারে (প্রলম্বিত প্রসব)। প্রসবের সময় শিশুর মাথা বের হয়ে ঘাড় আটকে যেতে পারে, এমনকি প্রসবকালীন শিশুর মৃত্যুও হতে পারে। ওজন বাড়তি থাকলে প্রসব–পরবর্তী সময়ে মায়ের অত্যধিক রক্তক্ষরণ হতে পারে, যা মাকেও মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে।
গর্ভবতী মায়েদের মাসে এক কেজি বা প্রতি দুই সপ্তাহে আধা কেজি ওজন বাড়া সুস্থতার লক্ষণ। গর্ভের শিশু বড় হওয়ার সাথে সাথে মায়ের বাড়তি এনার্জির প্রয়োজন। তাই গর্ভাবস্থার তৃতীয় ট্রাইমিস্টারে এসে আপনি বেশি বেশি পুষ্টিকর খাবার খাবেন। তবে অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি হয়ে থাকলে ওজনে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করুন।
গর্ভবতী মায়ের ঘুমানোর নিয়ম
চিকিৎসকরা গর্ভবতী নারীদের বাম পাশ ফিরে ঘুমাতে পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু কেন?
গর্ভকালে ভ্রুণ দিনদিন বড় হতে থাকে, তাই এটি স্বাভাবিকভাবেই তার মায়ের অভ্যন্তরীণ অর্গান ও রক্তনালীতে ক্রমান্বয়ে বেশি চাপ ফেলে। শিশু যখন ব্লাডারে অথবা অন্ত্রে লাথি মারে, তখন গর্ভবতী মা ব্যথা অনুভব করতে পারেন। এজন্য বাম পাশ ফিরে শোয়াই সব থেকে বেশি নিরাপদ। এতে রক্ত সঞ্চালন সহজতর হয়, গর্ভের শিশুর পুষ্টি জোগাতে আপনার হার্ট থেকে অমরা/গর্ভফুলে রক্ত সরবরাহের জন্য সহজ পথ তৈরি হয়। এভাবে শোয়াতে আপনার লিভার, অতিরিক্ত ওজনবিশিষ্ট শরীরের চাপ থেকে সুরক্ষিত থাকবে।
গর্ভাবস্থায় চিৎ বা উপুড় হয়ে শোবেন না। যখন উপুড় হয়ে শোবেন পাকস্থলী তখন আপনার প্রসারিত জরায়ুর উপর চাপ সৃষ্টি করবে। আপনি যদি চিত হয়ে ঘুমান তাহলে হয়তো আপনার নিঃশ্বাস নিতে বেশি কষ্ট হবে।
নিরাপদ গর্ভধারণে আরো কিছু টিপস্-
পেট ও পিঠকে একটু বেশি সাপোর্ট দিতে দুই হাঁটুর মাঝে একটি বালিশ ব্যবহার করুন।
শ্বাসকষ্ট থেকে রেহাই পেতে আপনার বুকের পাশেও একটি বালিশ আলতো করে রাখতে পারেন। এতে আপনার পাকস্থলী এসিডিটি থেকে মুক্ত থাকবে আর আপনার হার্ট এ জ্বালাপোড়াও কম অনুভব হবে।
এ কৌশল অবলম্বন করলে ঘুমন্ত অবস্থায় আপনার বডি আপনা-আপনিই আরামদায়ক পজিশনে থাকবে নতুবা আপনাকে জাগিয়ে দেবে। পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমোনো আপনার জন্য এখন খুব জরুরি। গর্ভাবস্থায় দিনের বেলা কমপক্ষে দু-ঘণ্টা ঘুম বা বিশ্রাম এবং রাতে কমপক্ষে আট ঘণ্টা ঘুম আবশ্যক। ঘুমের অভাবে আপনার প্রি-এক্লাম্পসিয়া বা উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। এটি গর্ভকালীন ডায়াবেটিস এবং পালমোনারি হাইপারটেনশনেরও আশঙ্কা তৈরি করে।
গর্ভবতী মায়ের সাবধানতা
গর্ভাবস্থায়, প্রসবের সময় বা প্রসবের পর, যেকোনো সময় যদি খিচুনি দেখা দেয় তবে দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে বিশেষায়িত হাসপাতালে মাকে ভর্তি করাতে হবে। খিচুনি একলামসিয়ার প্রধান লক্ষণ। দ্রুত পদক্ষেপ ও চিকিৎসায় বাচ্চা এবং মা দু’জনের জীবনই রক্ষা পাবে ইনশা’আল্লাহ।
গর্ভাবস্থায় যদি কেঁপে কেঁপে ভীষণ জ্বর আসে এবং প্রসাবের সময় জ্বালাপোড়া হয়, তবে তা মূত্রনালির সংক্রমণের ইঙ্গিত বহন করে। সময়মতো উপযুক্ত চিকিৎসা করালে অল্প সময়ে এ জটিলতা দূর হয়ে যায়।
প্রসবব্যথা যদি ১২ ঘণ্টার বেশি হয় অথবা প্রসবের সময় যদি বাচ্চার মাথা ছাড়া অন্য কোনো অঙ্গ বের হয়ে আসে, তবে বাসা-বাড়িতে প্রসবের চেষ্টা না করে সবারই উচিৎ মাকে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া।
গর্ভাবস্থায় বা প্রসবের পর মায়ের রক্তচাপ লক্ষ রাখা জরুরি। উচ্চ রক্তচাপ অনেক সময় মায়ের জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় এবং এটি একলামসিয়ার অন্যতম লক্ষণ। তাই যাঁরা আগে থেকেই উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত, তাদের উচিৎ ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক ওষুধ সেবন করে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং নিজ ও বাচ্চা উভয়ের সুস্থতা নিশ্চিত করা।
আপনি ঝুঁকলে, গর্ভস্থ আপনার পেটের উপর চাপ দেয়। এটি অ্যাসিড রিফ্লাক্সের কারণ হতে পারে। এ অ্যাসিড খাদ্যনালীতে ফিরে যায় এবং আপনার জিহ্বায় একটি অপ্রীতিকর স্বাদ ও আপনার খাদ্যনালীতে জ্বালার সংবেদন তৈরি করে।
এজন্য-
আপনার মাথা, ঘাড় এবং পিঠ একই সরল রেখায় রাখুন। দুই পা সর্বদা একই দিকে নির্দেশ করে রাখুন এবং উভয় পায়ে আপনার ওজন সমানভাবে ছড়িয়ে দিন। আপনার শরীরে টান প্রতিরোধ করতে লো-হিলযুক্ত জুতো বেছে নিন। গর্ভাবস্থায় কোনও কিছু জিনিস তোলার সময় আপনার পিঠ সোজা রাখুন এবং কেবল আপনার হাঁটু ও নিতম্ব বাঁকান।
প্রেগন্যান্সি পিরিয়ডে পেটের এক্সরে শিশুর birth defect এর কারণ হতে পারে। যদি কোনো ইমার্জেন্সি কারণে X-Ray করতে বলা হয়, সেক্ষেত্রে আপনার ডাক্তারকে প্রেগন্যান্সির ব্যাপারে জানান।
পূর্বে কোনো এবরশন বা MR / D&C করিয়ে থাকলে ডাক্তারকে জানান। এর আগে কোনো মৃত শিশু জন্ম দিলে বা জন্মের পর কোনো শিশুর মৃত্যু ঘটলেও-সেই বিষয়টি অবগত করুন। ১৮ থেকে ২২ সপ্তাহের মধ্যে একটি আল্ট্রাসনোগ্রাম করাতে পারেন, যেটাকে anomaly scan বলে। এর মাধ্যমে শিশুর জন্মগত ত্রুটি নির্ণয় করা সম্ভব
সকালে ও বিকেলে কিছু সময়ের জন্য স্বাস্থ্যকর ও মনোরম পরিবেশে হাঁটাহাঁটি গর্ভবতী মায়েদের জন্য উপকারি। এতে শরীর সুস্থ ও মন প্রফুল্ল থাকে। তাই সময় পেলে ফুলের বাগান, লেকের পাড়, পার্ক-এসব স্থানে একটু বেড়িয়ে আসুন।
Discussion about this post