অধ্যাপক ডা. এসএম মোস্তফা জামান
আজ বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। বিশ্বব্যাপী এ দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘একটি সুন্দর এবং সুস্থ বিশ্ব গড়ার লক্ষে এগিয়ে যেতে হবে’। আমরা জানি কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারির কারণে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্ব স্বাস্থ্য খাতের নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। আমাদের সারা বছর যেমন কিছু অসংক্রামক ব্যাধি থাকে সঙ্গে নানা ধরনের সংক্রামক ব্যাধি যা বাংলাদেশসহ সারাবিশ্ব একটি হুমকির সম্মুখীন করছে- যেমন কোভিড-১৯ সহ কয়েক বছর আগে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, ইবোলা।
একদিকে ধনী-গরিবের বৈষম্য অন্যদিকে দারিদ্র্যগোষ্ঠী এই করোনাকালে আরও বেশি কষ্টের মধ্যে জীবনযাপন করছে। গ্রামের অনেকেই আছেন যারা সঠিক পরিমাণে পুষ্টি পাচ্ছেন না এবং তাদের যে মৌলিক চাহিদা, বিশুদ্ধপানি ও স্যানিটাইজেশন ব্যবহার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এই মহামারিকালে তাদের কষ্টের সীমা আরও বেড়ে গেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস এমন সময় এসেছে যা বাংলাদেশে লকডাউনের মধ্যে আমারা পালন করছি সুতরাং আমাদের এই দিবসের যে প্রতিপাদ্য বিষয় তা হলো দেশের মানুষকে সচেতন করা, বিশ্ববাসীকে সচেতন করা। আমরা দেখছি যে অনেকেই আছেন সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন এবং ধনী-গরিবের বৈষম্য বাড়ছে; আমরা এই অবস্থায় কোভিডকালে আজকের যে স্বাস্থ্য খাতের চ্যালেঞ্জগুলো সেগুলো থেকে কীভাবে পরিত্রাণ পেতে পারি সে বিষয়গুলো এই দিনটি উদযাপনে নতুন করে ভাবার বিষয়।
আবারও বলছি যে কোভিডকালে অনেকেই আছেন তারা হয়তো উন্নত জীবনযাপন করছেন যারা স্বাস্থ্য খাতের সমস্ত সু্যােগ-সুবিধা ভোগ করছেন কিন্তু দেশের একটি বড় অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে তাদের যে স্বাস্থ্য খাতের মৌলিক চাহিদা তা তারা ভোগ করতে পারছে না। তাদের অপুষ্টি, তাদের মা ও শিশুস্বাস্থ্য, অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরের যে মৃত্যুহার এর সাথে বয়ঃবৃদ্ধ যারা আছেন তাদের যে স্বাস্থ্য খাতের সুযোগ-সুবিধা দেয়া দরকার তা দিতে আমরা পুরোপুরি সক্ষম হচ্ছি না। এ অবস্থা শুধু বাংলাদেশেই নয় এটি একটি গ্লোবাল সমস্যা।
আমরা বাংলাদেশের সকল মানুষকে কোভিড-১৯ টিকাদানের আওতায় আনতে পারিনি খুব অল্প সংখ্যক লোক কেই টিকাদানের আওতায় আনতে পেরেছি যদিও আগামী ৮ এপ্রিল থেকে কোভিড-১৯ টিকার দ্বিতীয় ডোজ শুরু হতে যাচ্ছে। আমরা জানি ২০২০ সালের ৮ মার্চ প্রথম বাংলাদেশে করোনা সনাক্ত হয় এবং ১১ মার্চ করোনাকে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষনা দেয় ও ১৮ মার্চ প্রথম বাংলাদেশি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আজ ৭ এপ্রিল ৩৯৬তম দিনে এসে পৌঁছেছি।
আমরা জানি বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য খাতের উন্নতির জন্য নানাভাবে সংগ্রাম করছে। আমাদের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেলেও দেশের অধিকাংশ মানুষ স্বাস্থ্য খাতের সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অর্থাৎ ধনী-গরিবের বৈষম্য ও সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসাব্যবস্থা বৈষম্য রয়েছে। এই বৈষম্য আমাদের দূর করা দরকার।
আমাদের স্বাস্থ্যের যেমন উন্নতি দরকার, শিক্ষার ও তেমন উন্নতি দরকার। কারণ স্বাস্থ্য ও শিক্ষার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ-সুবিধার উন্নতি প্রয়োজন। নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করা, যদিও এর কিছুটা উন্নতি হয়েছে এরপরও বলব এখনও আমরা পুরোপুরি উন্নতি করতে পারিনি। নারীর নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হবে, খাদ্য নিরাপত্তা সেই বিষয়টি নিয়েও ভাবতে হবে। যদিও আমাদের সরকার বিভিন্নভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানার নির্দেশনা দিয়েছেন কিন্তু সেভাবে মানা হয়নি।
প্রথম দিকে যে আতঙ্ক ছিল উদ্বেগ ছিল সেটির থেকে মানুষ নতুন সাধারণ জীবনে পদার্পণ করেছে ঠিক সেই সময় করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি মানুষকে আবার উদ্ধেগ-উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে দিয়েছে আর ঠিক সেই সময় আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস পালন করছি। এই দিবসের গুরুত্ব আবারও বলছি, আমরা যদি এই দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করতে চাই তাহলে এ বছরের যে প্রতিপাদ্য বিষয় সুন্দর ও সুষ্ঠু পৃথিবী গড়তে হলে আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। সরকারের সাথে জনগণের একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে পাশাপাশি চিকিৎসার যে মৌলিক চাহিদা তা সরকারকে পূরণ করতে হবে। মা ও শিশুর স্বাস্থ্য এবং সংক্রামক ও অসংক্রামক যে ব্যধি সে বিষয়ে আরও ভাবতে হবে বলে আমি মনে করি। আমাদের দেশের স্বাস্থ্যের যে অবকাঠামো সেটা ভালো রয়েছে, আমাদের দেশের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি সেটি বিশ্বের রোলমডেল। আমাদের শিশুদের টিকাদান কর্মসূচি তার যথেষ্ট উন্নতিসাধন হয়েছে, এমনকি আমাদের দেশে যখন রোহিঙ্গা শরণার্থী আসে তাদের শিশুদের সব ধরনের টিকা দেয়া ছিল না বরং আমাদের দেশে আসার পর আমরা রোহিঙ্গা শিশুদের আমাদের দেশের শিশুদের ন্যায় টিকা প্রদান করেছি।
এতে করে বাংলাদেশ টিকাদানে একটি রোলমডেলে পরিণত হয়েছে। আমাদের দেশের অন্যান্য যে চিকিৎসাসুবিধা যেমন হৃদরোগের আধুনিক চিকিৎসা যা সারা বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেতে পারিনি হয়তো মৌলিক কিছু চিকিৎসা দিচ্ছি কিন্তু সারাদেশকে আমরা আধুনিক চিকিৎসার অন্তর্ভুক্ত করতে পারছি না। এটি স্বাস্থ্য খাতের একটি চ্যালেঞ্জ।
আমরা জানি যে স্বাস্থ্য রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতিবছর অনেক লোক হৃদরোগের কারণে মারা যাচ্ছে। যেহেতু আমাদের দেশে এখনও উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিকস, শ্বাসকষ্ট, কিডনি রোগ ও লিভারের রোগ- এ রকম আরও বড় বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে কিন্তু কোনো হেলথ ইন্সুরেন্স নেই তাই অনেকেই নিজের টাকায় আধুনিক চিকিৎসাসেবা নিতে পারছেন না পাশাপাশি আমাদের দেশের ওষুধের দাম অন্যান্য দেশের তুলনায় কম হলেও দীর্ঘমেয়াদি ওষুধ গ্রহণ করতে অনেকেই নিজের টাকায় সক্ষম হচ্ছেন না।
এসব বিষয় নিয়ে সরকারকে আরও ভাবতে হবে। ২০২০ সালে করোনা আমাদের জীবনযাপনকে বদলে ফেলেছিল যে আমাদের আপনজনকেও শেষ বিদায়টুকু দিতে সক্ষম হইনি এটি আমাদের জন্য খুবই কষ্টের বিষয়। যাদের আপনজন না ফেরার দেশে চলে গেছেন তাদের সহানুভূতি দেয়ার মতো ভাষা আমাদের নেই।
এখনও যদি আমরা এ বিষয়ে সতর্ক না হই তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে। তাই আমাদের মৌলিক কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে, হাঁচি-কাশি শিষ্টাচার মানতে হবে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে এবং বর্তমান সরকারের ১৮ দফা নির্দেশনা ও লকডাউন মেনে চলতে হবে এবং সরকারকেও আরও বেশি লোককে কোভিড-১৯ টিকার আওতায় আনতে হবে।
লেখক : হল প্রভোস্ট ও অধ্যাপক, কার্ডিওলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
Discussion about this post