হার্টবিট ডেস্ক
গর্ভধারণের চতুর্থ মাস থেকেই সাধারণত শুরু হয় মাতৃত্বের দ্বিতীয় ধাপ। এই সময় গর্ভবতী মহিলারা শরীরে নানারকম পরিবর্তন অনুভব করে থাকেন। আর এই চতুর্থতম মাসেই গর্ভস্থ শিশুর বৃদ্ধি সব থেকে বেশি হয়। তাই, মমজংশনের এই পোস্টে আমরা আলোচনা করব গর্ভাবস্থার চতুর্থ মাসে হবু মায়েদের শরীরে হওয়া সকল শারীরিক পরিবর্তন এবং গর্ভে বেড়ে ওঠা বাচ্চাটির বৃদ্ধির হাল-হকিকত নিয়ে। আপনাকে জানাব সেই সব গুরুত্বপূর্ণ নজর রাখার মতো বিষয়গুলি সম্পর্কেও, যাতে আপনার সন্তান সঠিক পরিচর্যা পায়।
গর্ভাবস্থার চতুর্থ মাসের লক্ষণগুলি কি কি ?
এই সময় আপনার ফার্স্ট ট্রিমেস্টারের সমস্ত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলি কমে গিয়ে শরীরে নতুন লক্ষণ দেখা দেইয়। (1) চলুন দেখে নিই, কী কী লক্ষণ দেখে আপনি বুঝতে পারবেন যে গর্ভাবস্থার চতুর্থ মাস চলছে।
- কোষ্ঠকাঠিন্য
গর্ভাবস্থায় প্রজেস্টেরন হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধির কারণে হজম প্রক্রিয়াতে পরিবর্তন আসে, অন্ত্রের কার্যক্রম ও সঞ্চালন ধীর হয়ে পড়ে। ফলে অনেকের মধ্যে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দেখা যায়। বেশি ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে জল পান করলে হজম প্রক্রিয়া উন্নত হয় এবং কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যাও দূর হতে পারে। ডায়েট চার্ট মেনে খাবার খাওয়ার অভ্যাস এবং অলিভ অয়েল দিয়ে রান্না করে খেলে বা স্যালাডে মিশিয়ে খেলে এই অস্বস্তি দূর হতে পারে। গর্ভাবস্থায় কোনো জটিলতা না থাকলে, এই সময় দিনে ৩০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময়ের একটি ভালো উপায়।
- বুকজ্বালা
র্ভাবস্থায় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত পেট পরিপাকতন্ত্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। ফলে অনেকসময় পাকস্থলীর অ্যাসিডগুলি উপরের দিকে উঠে আসে এবং অম্বল ও বুক জ্বালার সমস্যার দেখা যায়। হরমোনের বৃদ্ধির কারণে হজম প্রক্রিয়াও হ্রাস পায়। গর্ভাবস্থায় বুকজ্বালা সাধারণ সমস্যা। ডায়েটে সামান্য কিছু পরিবর্তন, ভারী খাবরের পরিবর্তে সহজপাচ্য খাবার খেলে এবং বেশি করে জল খেলে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে।
- ঘনঘন প্রস্রাব পায়
এই সময় আপনার প্রসারিত জরায়ু মূত্রাশয়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করে, তাই ঘনঘন প্রস্রাব পায়। প্রস্রাবের সময় যদি জ্বর বা গায়ে- হাত-পায়ে ব্যথা বা তলপেটে ব্যথা অনুভব করেন অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।
- শ্বাসকষ্ট
বৃদ্ধিপ্রাপ্ত পেট ফুসফুসের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাই গর্ভাবস্থার এই সময় এবং পরবর্তী মাসগুলিতে শ্বাস নিতে অসুবিধা হতে পারে। সামান্য শ্বাসকষ্ট বা দ্রুত হৃৎস্পন্দন গর্ভাবস্থার চতুর্থ মাসের সাধারণ লক্ষণ। এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তবে, দ্রুত স্পন্দন বা শ্বাসকষ্ট যদি আপনার সহ্যাতীত হয়ে পড়ে বা আপনার হাঁটাচলা, কথা বলার মতো সাধারণ ক্রিয়াকলাপকে সীমাবদ্ধ করে তক্ষুণি হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেবেন।
- মাড়ি থেকে রক্তপাত
গর্ভাবস্থায় শরীরে হরমোনের আধিক্যের কারণে মাড়ি নরম ও সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। তাই, ব্রাশ করার সময়ে মাড়িতে ক্ষত বা সেখান থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে। তাই, দাঁতের চিকিৎসকের কাছে নিয়মিত চেকআপ করান এবং পরামর্শ মেনে চলুন।
- নাক থেকে রক্তপাত
গর্ভাবস্থায় শরীরের সর্বত্র রক্তের সরবরাহ বৃদ্ধি পায়। নাকের মধ্যে থাকা ক্ষুদ্র রক্তনালীগুলি রক্তের চাপ সহ্য করতে না পেরে সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। এমনকি, অনেকসময় রক্তনালীগুলি ফেটে গিয়ে নাক থেকে হালকা রক্তপাত হতে পারে যা অত্যন্ত স্বাভাবিক এই সময়। রক্তক্ষরণ অত্যাধিক হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।
- মর্নিং সিকনেস
গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাস সাধারণ হলেও, চতুর্থ থেকে পরবর্তী মাসগুলিতেও কেউ কেউ সকালে ঘুম থেকে উঠে ক্লান্তিভাব, গা গোলানো বা বমি বমিভাব অনুভব করতে পারেন।
- যোনী স্রাব
শরীরে হরোমোনের পরিবর্তনের কারণে ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জ বা সাদা যোনীস্রাব নির্গমন বেড়ে যেতে পারে।
গর্ভাবস্থার চতুর্থ মাসে শরীরের যেসব পরিবর্তন হয়
চতুর্থ মাসে শরীরের যেসব পরিবর্তন আসে তার মধ্যে সর্বাধিক পরিবর্তন স্পষ্ট হল একটি সুদৃশ্যমান বেবি বাম্প বা বড় পেট। সবথেকে ভালো ব্যাপার হল – গর্ভাবস্থায় গত তিন মাস ধরে চলে আসা সেই খিটখিটে মেজাজ, খাবারের প্রতি অনীহা – এর মত অপ্রীতিকর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াগুলি প্রায় অদৃশ্য হয়ে যায়, মর্নিং সিকনেসের প্রকোপ কমে; গর্ভাবস্থার এই ১৩-১৬ তম সপ্তাহে।
এই পর্যায়ে গর্ভপাতের সম্ভাবনা কমে যায়। আপনার শরীর ও মন তুলনামূলকভাবে আগের থেকে বেশ তরতাজা ও প্রাণবন্ত থাকে। আপনার গর্ভে আরও একটি প্রাণ বেড়ে উঠছে, তাই আপনার শরীরে কিছু শারীরিক পরিবর্তন আসাটা তো স্বাভাবিক। তাই না? যেমন –
- ত্বকের পরিবর্তন
গর্ভাবস্থায় শরীরে হরমোনের আধিক্যের কারণে অনেকসময় ত্বকে পরিবর্তন হয়। কিছু কিছু মহিলার ত্বক তাই এই সময় বিবর্ণ ও শুষ্ক হয়ে পড়ে। নিয়মিত ক্লিনজার, ময়েশ্চারাইজার ও লোশন লাগিয়ে ত্বকের যত্ন নেওয়া উচিৎ এই সময়।
- স্তনের পরিবর্তন
গর্ভাবস্থায় রক্ত চলাচল বাড়ার পাশাপাশি মহিলাদের স্তনের আকার বৃদ্ধি পায় এবং শিরাগুলি লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। হরমোনের পরিবর্তনের কারণে, স্তনববৃন্ত তার আশেপাশের অঞ্চল গাড় বাদামী আকার ধারণ করতে পারে।
- এডিমা –
চতুর্থ মাস ও গর্ভাবস্থার পরবর্তী মাসগুলিতে হাত ও পা ফুলতে পারে। দীর্ঘক্ষণ এক টানা বসে বা দাঁড়িয়ে না থেকে মাঝেমধ্যে বিরতি নিয়ে অবস্থানের পরিবর্তন করলে এই ফোলাভাব কমতে পারে। তবে অবস্থা গুরুতর হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।
- ভ্যারিকোজ শিরা (varicose veins)
দেহে রক্তের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য পায়ের শিরাগুলি বড় হতে পারে। যাকে বলে varicose veins। এমনকি, পেটে ও উরুর পাতলা চামড়ার ওপর হালকা লালচে প্যাচ বা ফাটলের মত দাগ দেখা যায়। প্রসবের পর দাগগুলি বিবর্ণ হয়ে মিলিয়ে যায়।
এছাড়া এই সময়, গর্ভাশয় প্রসারিত হওয়ার কারণে পিঠ, পেট, উরু ও কুঁচকি এলাকায় টান বা চাপ বা ব্যথা অনুভব করতে পারেন। ক্ষুধা বৃদ্ধি পায়। তবে, পরিবর্তন সে অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক যাই হোক, আপনার শরীরের এই সব লক্ষণগুলিই আপনাকে বারবার অনুভব করাবে মা হওয়ার সেই স্বর্গীয়সুখ।
গর্ভাবস্থার চতুর্থ মাসে শিশুর বিকাশ
গর্ভধারণের চতুর্থ মাসে গর্ভস্থ বাচ্চার বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে তাই মায়ের শরীরে আয়রনের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। এই পর্যায়ে ভ্রূণ এবং নাড়ি গঠন করার জন্য আপনার রক্তের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। মাথা থেকে পা পর্যন্ত এই সময় আপনার গর্ভস্থ সন্তানের মাপ থাকে প্রায় ৬-৭ ইঞ্চি।
আপনার সন্তানের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য এবং সংজ্ঞাবহ ইন্দ্রিয়গুলি এই সময় সুগঠিত হয়, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি এখন আরও বেশি সক্রিয় এবং নমনীয় হয়ে ওঠে। আল্ট্রাসাউন্ড করলে, আপনার ছোট্ট সোনাটির অসাধারণ সব কার্যকলাপ, অভিব্যক্তি চাক্ষুষ করতে পারবেন। মস্তিষ্কের স্নায়ু ও মুখের পেশী সুগঠিত হয়ে যাওয়ার কারণে, সে এখন আঁকড়ে ধরতে, বুড়ো আঙুল চুষতে এমনকি ভেংচি কাটতেও শিখে যায়।
আপনার সঙ্গে সঙ্গে আপনার সন্তানেরও এই সময় শারীরিক পরিবর্তন হয়। ভ্রূণ থেকে ধীরে ধীরে পরিপূর্ণ মানুষের আদলে বেড়ে ওঠার এই পর্যায়ে তার বিকাশের চিত্ররূপটা হল
দেহের অংশ | বিবর্তনের পর্যায় |
মুখের বৈশিষ্ট্য | চোখ, কান, নাক, চুল ও মুখের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলি আরও প্রকট হয়ে ওঠে |
কান | কানের হাড় শক্ত হয়। সমগ্র কানের গঠনের বিকাশ ঘটে। |
ঘাড় | গঠিত |
ত্বক | স্বচ্ছ ত্বকের সঙ্গে শিরাগুলি দৃশ্যমান হয়। ত্বকের নীচে ফ্যাট সেল বা কোষের গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। |
ফুসফুস | গঠন শুরু হয়। তবে শ্বাসযন্ত্রের অঙ্গ হিসেবে কার্যকরী হয় না। |
কঙ্কাল তন্ত্র | হাড় এবং পেশীর বিকাশ হতে থাকে |
চুল | শরীর জুড়ে ল্যানুগো দেখা যায় যা নরম ত্বকের সুরক্ষা দেয় |
চোখের পাতা | বিকাশ শুরু হয় |
আঙ্গুলের ছাপ | অনন্য বা ইউনিক হতে শুরু করে |
লেজ | সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে যায় |
হাত ও পা | ফ্লেক্সিবেল হয়ে ওঠে |
কিডনি | কার্যকরী হয়ে ওঠে |
চতুর্থ মাসের যত্ন
আপনার বাচ্চার সঠিক পরিচর্যার পাশাপাশি, এই সময় নিজেকে সুস্থ রাখাও প্রতিটা মায়ের দায়িত্ব ও কর্তব্য। জেনে নিন এই সময় কী কী করা উচিৎ আর কী কী উচিৎ না।
যা যা করণীয়
- চিকিৎসকের অনুমতি নিয়ে, হাঁটা, যোগব্যায়াম, সাঁতার বা আপনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন এমন কিছু সহজ ওয়ার্ক আউট করার যে অভ্যাস আছে তা চালিয়ে যান।
- বাম দিকে কাত হয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করুন। আরামের জন্য চারপাশে এবং দু’পায়ের মধ্যে বালিশ নিতে পারেন। শোওয়ার সময় মায়ের এই অবস্থান গর্ভস্থ ভ্রূণের মধ্যে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে।
- নাক থেকে হাল্কা রক্তপাত হওয়া, স্টিফ নোজ বা কান ব্লক হয়ে যাওয়া খুব সাধারণ সমস্যা। তাই, হাতের কাছে টিস্যু ও প্রয়োজনীয় ওষুধ রাখার চেষ্টা করুন।
- কিছু মেটার্নিটি জামাকাপড় মানে হালকা কম টাইট এরকম জামাকাপড় পরার চেষ্টা করুন। আরাম পাবেন।
- এই সময় যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হওয়ার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ অবশ্যই নেবেন।
- মাড়ি থেকে রক্তপাতের মত ওরাল কমপ্লিকেশন এড়ানোর জন্য নিয়মিত ডেন্টাল চেকআপের জন্য যান।
যা যা করা উচিৎ নয়
- মদ্যপান করবেন না। গর্ভাবস্থায় মদ্যপান করলে ভ্রূণের ফেটাল অ্যালকোহল সিন্ড্রোম (FAS) দেখা দিতে পারে।
হট টাব বাথ নেবেন না, কারণ উচ্চ তাপমাত্রা গর্ভস্থ ভ্রূণের পক্ষে ক্ষতিকারক।
- ধূমপান করবেন না। ধূমপান করলে বাচ্চার মধ্যে প্রতিবন্ধকতা বা জন্মানোর সময় নিম্ন ওজনের হওয়ার ঝুঁকি দেখা দিতে পারে।
Discussion about this post