অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ আরাফাত চেয়ারম্যান, মেডিসিন অনুষদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
বেশ কিছুদিন শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকার পর মার্চের শেষে এসে হঠাৎ করেই আবার করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুহার—দুটোই বাড়তে শুরু করেছে। জুলাই মাসের পর এই তো ২৩ মার্চ ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের সংখ্যা হলো সাড়ে তিন হাজারের বেশি। হাসপাতালের শয্যা খালি নেই, নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) জন্য হাহাকার। করোনা রোগী নিয়ে স্বজনেরা এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটে বেড়াচ্ছেন।
এদিকে বাংলাদেশে যুক্তরাজ্যের নতুন ধরনের করোনাভাইরাস ‘এন ৫০১ ওয়াই’-এর স্ট্রেইন পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিশ্চিত করেছে, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ধরনটি বাংলাদেশে প্রথম শনাক্ত হয়। এখন পর্যন্ত এটি কত বিস্তৃতভাবে ছড়িয়েছে, তা জানার চেষ্টা করছে তারা। আমরা জানি, এ পর্যন্ত বিশ্বের ৮৩টি দেশে এই নতুন ধরন পাওয়া গেছে।
কেবল বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও বাড়ছে করোনা সংক্রমণ। এরই মধ্যে ফ্রান্সসহ কিছু দেশ আবারও লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশেও স্বাস্থ্য গবেষকেরা মনে করেন, আংশিকভাবে হলেও গণচলাচল ও জনসমাগমে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া উচিত, নয়তো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। গত বছরও গ্রীষ্মের শুরুতেই দেশে করোনা সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছিল। বিশেষজ্ঞরা একে নতুন ধরন বা দ্বিতীয় ঢেউ বলছেন।
সংক্রমণ আর মৃত্যুর এই ঊর্ধ্বহার নতুন ধরনের কারণে কি না, তা জিনোম সিকোয়েন্সিং ছাড়া বলা কঠিন। ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য দেশের গবেষণা বলছে, যুক্তরাজ্যের এই নতুন ধরন ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বেশি সংক্রামক। এটি আগের তুলনায় অনেক বেশি দ্রুত ছড়াতে সক্ষম। তাই যেকোনো সমাবেশ বা সামাজিক অনুষ্ঠান থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষ একসঙ্গে আক্রান্ত হতে পারেন।
যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, এই ধরনের মৃত্যুহারও বেশি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ৬০ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিদের মধ্যে পুরোনো ধরনে যেখানে ১ হাজার জনে ১০ জনের মৃত্যুর শঙ্কা আছে, সেখানে নতুন ধরনে মৃত্যুর হার ১৩ জন হতে পারে। যদিও শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে মৃত্যুহার বেশি পরিলক্ষিত হয়নি, তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা, করোনা চিকিৎসায় অর্জিত অভিজ্ঞতা, চিকিৎসাসেবার সুযোগ বৃদ্ধি ও টিকা কার্যক্রম এই মৃত্যুহার কমাতে ভূমিকা রেখেছে।
আরেকটি বিষয় দেখা গেছে, এই নতুন ধরনের ভাইরাসে অপেক্ষাকৃত কম বয়সীরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছিলেন। তবে এর কারণ হতে পারে যে কম বয়সীরা অনেক বেশি বাইরে ও কাজে যাচ্ছিলেন এবং সে সময় যুক্তরাজ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা ছিল। আমাদের দেশে কারা বেশি আক্রান্ত হতে পারেন, তা এখনই বলা মুশকিল। তবে লক্ষণীয় যে বর্তমানে সব বয়সের মানুষই দেশে প্রয়োজন ছাড়াই বের হতে শুরু করেছেন।
নতুন ধরন নিয়ে আরেকটি সমস্যা হলো, এটি আরটি-পিসিআর পরীক্ষায় কতটা নির্ভুলভাবে শনাক্ত করা যাবে, তা নিয়ে এর আগেই আমাদের বিশেষজ্ঞরা সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। এই ধরনটি শনাক্ত করতে থ্রি জিন পরীক্ষা করা উচিত বলে তাঁরা মতামত দিয়েছিলেন। ফলে উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও পিসিআর নেগেটিভ হয়ে অনেকে আইসোলেশনে না গিয়ে সংক্রমণ ছড়াতে পারেন।
আমরা কতটা প্রস্তুত
এখন প্রশ্ন হলো, নতুন ধরনের এই করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোকাবিলায় আমরা কতটা প্রস্তুত?
- ধরন যা-ই হোক, করোনা মোকাবিলার সবচেয়ে কার্যকর পন্থা হচ্ছে মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও বারবার হাত ধোয়ার মতো স্বাস্থ্যবিধি পালন; যা থেকে আমরা অনেক দূরে সরে এসেছি। এই মুহূর্ত থেকে সব স্বাস্থ্যবিধি পালন আবার জোরেশোরে শুরু করতে না পারলে সামনে হয়তো খারাপ সময় দেখতে হবে আমাদের। বিশেষ করে বাড়ির বাইরে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করতে হবে। সরকারের ঘোষিত ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ বিধিটি যেন সত্যিকারভাবে কার্যকর হয়, সেদিকে কড়া নজর দিতে হবে।
- সাম্প্রতিক সময়ে পর্যটন, সামাজিক অনুষ্ঠান, উৎসব ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ বেড়েছে। সামনে রয়েছে বাংলা নববর্ষ, পবিত্র রমজান ও ঈদুল ফিতর। এ উপলক্ষে মানুষের চলাচল, কেনাকাটা, ভ্রমণ ও সমাবেশ আরও বাড়বে। এখনই সময় এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বিধিনিষেধ আরোপ করা ও সচেতন হওয়া। এমনকি রমজানে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি, তারাবিহ নামাজের সমাবেশ ইত্যাদি বিষয়েও স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টিতে জোর দিতে হবে। নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে ইবাদত করা, মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক রাখা, মসজিদ বা প্রার্থনালয়ে প্রবেশের আগে–পরে হাত ধোয়া, মেঝে বারবার জীবাণুমুক্ত করা ইত্যাদি বিষয়ে জোর দিতে হবে।উৎসবের আগে বিপণিবিতানে স্বাস্থ্যবিধি মানা বাধ্যতামূলক করতে হবে। রেস্তোরাঁ, হোটেল, পর্যটন স্থান ইত্যাদিতেও বাধ্যবাধকতা বাড়ানো উচিত এখনই। সবচেয়ে ভালো হয়, অপ্রয়োজনীয় সমাবেশ ও ঘোরাঘুরিতে বিধিনিষেধ আরোপ করা। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের শুরুতে ভারতের কয়েকটি প্রদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশই আবারও এ ধরনের আংশিক লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছে।
- পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে সামনে বিদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারেন। তাঁদের যথাযথভাবে কোয়ারেন্টিন করা, নজরদারি করা বা পরীক্ষার আওতায় আনার ব্যাপারে মনোযোগ বাড়াতে হবে। বিমানবন্দর, বাস ও রেলস্টেশনগুলোতে বাড়াতে হবে স্বাস্থ্য সুরক্ষার সব উপায়।
- বর্তমানে স্বাস্থ্যবিধি যেমন অনেকেই মানছেন না, তেমনি অনেকেই জ্বর-কাশির উপসর্গ হলে তেমন আমলে না নিয়ে সামাজিক মেলামেশা করছেন, অফিসে যাচ্ছেন। নমুন পরীক্ষার প্রতিও আগ্রহ কমেছে অনেকের। এই প্রবণতা রোধ করতে হবে। করোনার উপসর্গ দেখা দেওয়ামাত্র আগের মতো আইসোলেশনে থাকার ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে হবে।
- করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি এবং এর গতিবিধি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে তবেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হল, ছাত্রাবাস খোলা উচিত। তার আগে নয়। সব শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে টিকা দেওয়ার ঘোষণা প্রশংসাজনক, তবে তা দ্রুতই সম্পন্ন করতে হবে।
- স্বাস্থ্যবিধি পালন ছাড়া করোনা অতিমারি রোধের দ্বিতীয় কার্যকর উপায় হচ্ছে করোনার টিকা। দ্রুততম সময়ে যত বেশিসংখ্যক মানুষকে টিকার আওতায় আনা যাবে, ততই মঙ্গল। গবেষণা বলছে, টিকাদানের পর করোনা সংক্রমণ হবে না তা নয়, তবে তার তীব্রতা ও হাসপাতালে ভর্তি বা মৃত্যুঝুঁকি অনেকটাই কমবে। আরও বেশিসংখ্যক মানুষকে টিকা দিতে হলে গ্রামে গ্রামে ও শহরের এলাকায় নিবন্ধন বুথ খুলে, দরকার হলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে ইপিআই কার্যক্রমের আদলে মানুষকে টিকা দিতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তবে টিকা নেওয়ার পরও যে মাস্ক পরা ও হাত ধোয়ার মতো স্বাস্থ্যবিধি ছাড়া যাবে না, সে বিষয়ে জনগণকে সচেতন করতে হবে।
তবে সরকারের পক্ষে স্বাস্থ্যবিধি পালনে বাধ্য করা সম্ভব নয়, যদি না মানুষ সচেতন হয়। তাই সচেতনতাই পারে আপনার পরিবারের ও অন্যের জীবন রক্ষা করতে।
Discussion about this post