হার্টবিট ডেস্ক
জাতীয় যক্ষ্মা নির্মূল কর্মসূচির এক অনুষ্ঠানে সম্প্রতি বৈশ্বিক মহামারি করোনার তুলনায় যক্ষ্মা রোগকে ভয়ানক বলে আখ্যায়িত করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘করোনাভাইরাসে গত এক বছরে মৃত্যু হয়েছে সাড়ে আট হাজারের কিছু বেশি মানুষের। অন্যদিকে, যক্ষ্মা রোগে গত এক বছরে মৃত্যু হয়েছে ৩৬ হাজারের বেশি মানুষের। এ হিসাবে করোনার তুলনায় যক্ষ্মা রোগে চার গুণ বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। সুতরাং যক্ষ্মা রোগকে অবহেলা করা যাবে না।’
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের সূত্র ধরে খোঁজ নিয়ে যক্ষ্মা রোগের ভয়াবহতার চিত্র পাওয়া গেছে। জাতীয় যক্ষ্মা নির্মূল কর্মসূচির পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রতিদিন যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে ১০৭ জনের মৃত্যু হচ্ছে। প্রতিদিন শনাক্ত হয় ৯৮৭ জন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যানে অবশ্য বাংলাদেশে প্রতিদিন যক্ষ্মা রোগে আরও বেশি মৃত্যুর তথ্য দেওয়া হয়েছে। সংস্থাটি বলছে, প্রতিদিন যক্ষ্মা রোগে ১৮৫ জন মৃত্যুবরণ করছেন। এর বিপরীতে করোনায় প্রতিদিন গড়ে ২০ জন মৃত্যুবরণ করছেন। এই হিসাব বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, করোনার তুলনায় যক্ষ্মা রোগে ৯ গুণ বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করছেন। সচেতন না হলে যক্ষ্মায় মৃত্যু আরও বাড়তে পারে বলে সতর্ক করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সবচেয়ে আতঙ্কের তথ্য হলো- যক্ষ্মা রোগীরা উল্লেখযোগ্য হারে করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন। রাজধানীর ২৫০ শয্যা শ্যামলী টিবি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন যক্ষ্মা রোগীদের মধ্যে প্রায় ৩ শতাংশ করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছেন। এ ঘটনা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ওই হাসপাতালে আপাতত করোনা পজিটিভ রোগী ভর্তি বন্ধ রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজধানীর ২৫০ শয্যার শ্যামলী টিবি হাসপাতালের প্রকল্প পরিচালক ও উপপরিচালক ডা. আবু রায়হান বলেন, করোনাভাইরাসের মতো যক্ষ্মাও একটি সংক্রামক রোগ। দুটি রোগেই ফুসফুস সংক্রমিত হয়। তার হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ২ থেকে ৩ শতাংশ যক্ষ্মা রোগী করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছেন। নতুন করে যক্ষ্মা আক্রান্তদের করোনা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। আবার করোনা পজিটিভ ব্যক্তিরও যক্ষ্মা পরীক্ষা করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
তিনি আরও বলেন, যক্ষ্মা রোগীর করোনা পজিটিভ শনাক্ত হওয়ার পর তার হাসপাতালে করোনা পজিটিভ রোগী ভর্তি আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে।
বৈশ্বিক করোনাভাইরাস মহামারির উদ্বেগের মধ্যেই আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার যক্ষ্মামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার’। তবে করোনা মহামারির কারণে যক্ষ্মাসহ অন্যান্য রোগের চিকিৎসা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। এতে অন্যান্য রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। কয়েকজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সতর্ক করে বলেছেন, চলমান করোনা পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া ও এইচআইভি নিয়ন্ত্রণে অগ্রগতি কয়েক বছর, এমনকি কয়েক দশক পিছিয়ে পড়তে পারে। তাদের অভিমত, করোনা মহামারি শেষ হলেও এর প্রভাব দীর্ঘদিন থেকে যাবে। দীর্ঘদিন ধরে রোগ শনাক্ত না হলে চিকিৎসা পেতেও বিলম্ব হবে। এতে করে অধিক মানুষ আক্রান্ত এবং মৃত্যুবরণ করবে। তাই দ্রুত এ ধরনের রোগ শনাক্ত করে চিকিৎসার প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও করোনার চেয়ে যক্ষ্মা বড় উদ্বেগের কারণ হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর প্রায় ১৫ লাখ মানুষ যক্ষ্মায় মারা যান। করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে বিশ্বজুড়ে সৃষ্ট লকডাউনের কারণে সরবরাহ শৃঙ্খলা যেভাবে ভেঙে পড়েছে, তাতে যক্ষ্মা, এইচআইভি ও ম্যালেরিয়ার মতো রোগগুলো ভবিষ্যতে বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে ৮০ শতাংশ যক্ষ্মা, এইচআইভি ও ম্যালেরিয়া কর্মসূচির আওতায় থাকা সেবা বিঘ্নিত হয়েছে। এ-সংক্রান্ত একটি পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন অংশে লকডাউন এবং অন্যান্য কারণে আরও ৬৩ লাখ মানুষ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত এবং ১৪ লাখ মানুষের মৃত্যু হতে পারে।
সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো গ্লোবাল ফান্ডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা পরিস্থিতির কারণে যক্ষ্মা, এইচআইভি ও ম্যালেরিয়া রোগ প্রতিরোধের অগ্রগতিতে যে ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণ করতে দুই হাজার ৮৫০ কোটি ডলারের প্রয়োজন পড়বে।
গ্লোবাল যক্ষ্মা প্রতিবেদন ২০২০ সালের তথ্যানুযায়ী, যক্ষ্মা রোগে আক্রান্তের তালিকায় বাংলাদেশ সপ্তম স্থানে রয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিবছর বাংলাদেশে তিন লাখ ৬১ হাজার মানুষ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রতি লাখে ২২১ জন যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রতি লাখে মৃত্যুবরণ করছেন ২৪ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যক্ষ্মা নির্মূল কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. শামিউল ইসলাম বলেন, সার্বিকভাবে কত শতাংশ যক্ষ্মা রোগী করোনা পজিটিভ হয়েছেন- এ-সংক্রান্ত তথ্য তাদের কাছে নেই। তবে যক্ষ্মা রোগী করোনা পজিটিভ হয়েছেন, এমন বেশ কিছু তথ্য তারা পেয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, বৈশ্বিক করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে গত বছরের মার্চ থেকে মে পর্যন্ত সরকারি ছুটির কারণে সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় যক্ষ্মা শনাক্তকরণের বিষয়টি চ্যালেঞ্জিং ছিল। তখন কিছুটা শিথিলতা দেখা দেয়। তবে এখন আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। শনাক্তকরণ কাজ এগিয়ে চলছে। করোনার মধ্যেও অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় যক্ষ্মা নির্মূলে বাংলাদেশ বেশি সফল। ২০৩৫ সালের মধ্যে দেশে যক্ষ্মা রোগে মৃত্যুহার শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ চলছে। গত পাঁচ বছরে এ লক্ষ্য অর্জনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। ২০১০ সালে প্রতি লাখে ৫৪ জন যক্ষ্মা আক্রান্ত ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করতেন। ২০২০ সালে তা ২৪ জনে নেমেছে। যক্ষ্মা রোগী নিয়মিত ও নির্দিষ্ট মেয়াদে ওষুধ সেবন করলে চিকিৎসায় সাফল্যের হার প্রায় ৯৬ শতাংশ।
কর্মসূচি: দিবসটি উপলক্ষে আজ বুধবার সকালে রাজধানীর মহাখালীর স্বাস্থ্য ভবনের সামনে শোভাযাত্রা এবং পরে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল মিলনায়তনে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।
Discussion about this post