হার্টবিট ডেস্ক
করোনা মহামারি মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এনেছে। কোয়ারেন্টিন এবং লকডাউন চলাকালীন বেশিরভাগ মানুষই দাঁত ব্রাশসহ মুখের যত্নের প্রতি অনাগ্রহী হয়েছে। এমনকি অভিভাবকদের কাছে শিশুদের দাঁতের যত্নেও গুরুত্ব কমেছে বলে জরিপে উঠে এসেছে। তবে নাক-মুখের মাধ্যমেই শরীরে করোনাভাইরাস প্রবেশ করে। তাই করোনা থেকে নিরাপদ থাকতে মুখগহ্বরের যত্ন অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
সারা বিশ্বে করোনা মহামারির এই ভয়াবহ সময়ে আজ পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব মুখগহ্বর স্বাস্থ্য দিবস বা ওয়ার্ল্ড ওরাল হেলথ ডে-২০২১’। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য-‘বি প্রাউড অব ইওর মাউথ’। সম্প্রতি বিশ্ব মুখগহ্বর স্বাস্থ্য দিবস বা ওয়ার্ল্ড ওরাল হেলথ ডে-২০২১ উপলক্ষ্যে পেপসোডেন্ট এক জরিপ পরিচালনা করে।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৬৪ শতাংশ জানিয়েছেন মহামারির শুরুর পর থেকে তারা মুখগহ্বরের স্বাস্থ্যের সমস্যায় পড়েছেন। বাংলাদেশে ৩১ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক দিনে দুবার দাঁত ব্রাশ করেননি। ৩৩ শতাংশ বাবা-মা দিনে দুবার দাঁত ব্রাশ করেননি। ৩৫ শতাংশ শিশু দিনে দুবার দাঁত ব্রাশ করেনি। প্রাপ্তবয়স্করা স্বীকার করেছেন, করোনাকালে ঘরে থেকে থেকে তাদের অভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে। শিশুদের দৈনন্দিন শৃঙ্খলায় শিথিলতা দেখা দিয়েছে।
পৃথিবীর ৮টি দেশে (ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, ফ্রান্স, বাংলাদেশ, মিশর, ঘানা ও ভারত) ছয় হাজার ৭০০ জন এই জরিপে অংশ নেন। জরিপে প্রতি ৫৪ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক বলেছেন, এমনও দিন গেছে তারা একবারও দাঁত ব্রাশ করেননি। যার মূল কারণ অলসতা। চাকরিজীবী অর্ধেকের বেশি প্রাপ্তবয়স্ক (৫৯ শতাংশ) বলেছেন, এমন হয়েছে যে দাঁত ব্রাশ না-করেই তারা কাজে গিয়েছেন। এ ছাড়া অধিকাংশ বাবা-মা স্বীকার করেছেন তারা শিশুদের মুখগহ্বরের যত্নের ব্যাপারেও উদাসীন হয়েছেন। জরিপে অংশ নেওয়া ৬৯ শতাংশ বাবা-মা বলেছেন, ঘুমানোর আগে তারা সন্তানকে মিষ্টিজাতীয় খাবার খেতে দিয়েছেন।
মুখগহ্বরের স্বাস্থ্য নিয়ে সমস্যা সত্ত্বেও বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। এক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা ও শারীরিক স্বাস্থ্য সমস্যা গুরুত্ব পাচ্ছে। জরিপে অংশগ্রহণকারীরা করোনাকালে সবচেয়ে বেশি যে ৫টি মুখের সমস্যার মধ্যদিয়ে গিয়েছেন, দাঁত, মাড়ি, মুখে ব্যথার কথা জানিয়েছেন ৩০ শতাংশ, দাঁত ও মাড়িতে রক্তপাতের কথা জানিয়েছেন ২৭ শতাংশ, মুখে ব্যথার কারণে খেতে পারছেন-না বলে জানিয়েছেন ২৭ শতাংশ অংশগ্রহণকারী।
এ ছাড়া দাঁতের ব্যথার কারণে মাথাব্যথার কথা জানিয়েছেন ২৭ শতাংশ এবং চোয়াল ব্যথার কথা জানিয়েছেন ২৫ শতাংশ। প্রাপ্তবয়স্কদের ৫০ শতাংশ বলেছেন, মহামারির সময় দাঁত ব্যথার অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে যেতে হয়েছে। তাদের মধ্যে, ২১ শতাংশ মৃদু দাঁত ব্যথা উপলব্ধি করেছেন। ২২ শতাংশের দাঁত ব্যথা ছিল। ৮ শতাংশকে প্রবল দাঁত ব্যথার মধ্যে কাটাতে হয়েছে।
প্রাপ্তবয়স্করা অন্যান্য স্বাস্থ্য পরিচর্যার চেয়ে মুখগহ্বর স্বাস্থ্যের প্রতি কম মনোযোগী ছিলেন, অন্যান্য শারীরিক সমস্যার যত্ন নিয়েছেন ৭২ শতাংশ। মানসিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতার প্রতি যত্নশীল ছিলেন ৭৯ শতাংশ। ওরাল বা মুখগহ্বরের স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল ছিলেন ৬২ শতাংশ।
কোয়ানটিটিভ ও কোয়ালিটেটিভ উভয় গবেষণাতেই, প্রাপ্তবয়স্করা জানিয়েছেন মহামারির সময়ে তারা ডেন্টিস্টের কাছে যাওয়া পরিহার করছেন। ৭৬ শতাংশ বলেছেন, মহামারির পর থেকে তারা চেকআপের জন্য ডেন্টিস্টের কাছে যাওয়া পরিহার করেছেন। ৬৮ শতাংশ বলেছেন, সমস্যায় ভোগার পরও তারা দাঁতের চিকিৎসকের কাছে যাননি এবং ৩৬ শতাংশ বলেছেন, তারা গত এক বছরে ডেন্টিস্টের কাছে যাননি। এমনকি মারাত্মক ব্যথা অনুভবের পরও অনেকে ডেন্টিস্টের কাছে যাননি।
এ ছাড়া জরিপে আরও দেখা যায়, বাবা-মা যদি দিনে দুবার ব্রাশ না-করে সন্তানের ব্রাশ না-করার হার ৭ গুণ বেড়ে যায়। যখন বাবা-মা দিনে দুবার ব্রাশ করে, সন্তানের ব্রাশ করা এড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা মাত্র ১১ শতাংশ। যখন বাবা-মা ব্রাশ করা এড়িয়ে যায়, সন্তানের ব্রাশ করা এড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ৭৭ শতাংশ। জরিপে দেখা গেছে, দাত ব্রাশ করার চেয়ে হাত ধোয়ার মতো ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যসুরক্ষায় সচেতনতা বেড়েছে ৪৫ শতাংশ। মহামারি শুরুর পর মাউথওয়াশ ব্যবহারের তুলনায় হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার বেড়েছে ৪০ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ডেন্টাল সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা ডেন্টাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. হুমায়ুন কবীর বুলবুল বলেন, করোনা মহামারির কারণে দেশের মানুষের মধ্যে অনেক নিয়মকানুনের পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে, দুই বেলা দাঁত ব্রাশ করা, ব্রাস ও মাউথ ওয়াশ ব্যবহার করা ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিপালিত হচ্ছে না। অর্থাৎ, দাঁত ও মুখগহ্বরের সাধারণ যত্ন উপেক্ষিত হয়েছে। তা ছাড়া মহামারির পুরোটা সময় চিকিৎসা না-করায় দেশের মানুষের দাঁত ও মুখের রোগ বেড়েছে। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের সঙ্গে মুখগহ্বর অনেকাংশে জড়িত। কারণ, এই প্রাণঘাতী ভাইরাস মানুষের নাক ও মুখের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। ভাইরাস দুদিন পর্যন্ত মুখগহ্বরে অবস্থান করে। এক্ষেত্রে পভিডন আয়োডিনযুক্ত মাউথ ওয়াশ ব্যবহার করলে ভাইরাসের লিপিড স্তর ভেঙে যায়। ফলে ভাইরাসের মৃত্যু ঘটে।
Discussion about this post