অধ্যাপক আ ব ম ফারুক
সারা দেশে টিকা নেওয়ার জন্য টিকাদান কেন্দ্রগুলোতে আগ্রহী মানুষের ভিড় ক্রমাগত বাড়ছে। যারা অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করেছেন, তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন কবে টিকা নেওয়ার ডাক আসে। টিকার বিরুদ্ধে যারা নানা রকম অপপ্রচার করছিলেন, তারা ব্যর্থ ও হতাশ হয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষ আরেকবার প্রমাণ করলেন যে তারা মিথ্যা ও অপপ্রচারকে দূরে ঠেলে সত্যকে সব সময় গ্রহণ করেন।
যত ভিড়ই হোক, সবাইকে টিকা দেওয়ার মতো যথেষ্ট টিকা সরকারের হাতে মজুত আছে। বর্তমানের ৭০ লাখ ডোজ শেষ হওয়ার আগেই মোট ৩ কোটি টিকার বাকি আড়াই কোটি ডোজ এবং তারপর মোট ৬ কোটি ৮০ লাখ ডোজ টিকা সরকারের হাতে আসবে। এগুলো সবই আসবে প্রয়োজনমাফিক নির্দিষ্ট বিরতিতে। কোনো সমস্যা ছাড়াই নিরবচ্ছিন্ন ও নিয়মিতভাবে সব কেন্দ্রে চাহিদার অতিরিক্ত টিকা পাঠানো কম কথা নয়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার এই বিতরণব্যবস্থা ভালোভাবেই সামাল দিয়েছে। আগামী দিনগুলোতেও সরকার তা পারবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেকগুলো রাজ্যে এই মুহূর্তে টিকাদান চলছে। কিন্তু পেনসিলভানিয়া, ম্যাসাচুসেটসসহ অনেক রাজ্যে প্রথম ডোজ যারা নিয়েছেন এবং যাদের দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার সময় এসেছে, তারা তা নিতে পারছেন না। কারণ টিকাদান কেন্দ্রে কোনো টিকা নেই বলে প্রথম বা দ্বিতীয় কোনো ডোজই দেওয়া যাচ্ছে না। হাসপাতাল ও ফার্মেসিগুলো দুঃখ প্রকাশ করে ইতিমধ্যে টিকা গ্রহীতাদের জানিয়েছে, টিকার স্টক না থাকার কারণে তারা টিকা দিতে অপারগ। তারা টিকাদান পুনরায় শুরু করতে দুই সপ্তাহ সময় চেয়েছে। সেখানে টিকার সুষ্ঠু বিতরণের জন্য সেনাবাহিনীকে কাজে লাগিয়েও টিকার সংকটের কারণে তার সুরাহা হচ্ছে না। কানাডা, জার্মানিসহ ইউরোপের প্রায় সব দেশেও একই অবস্থা। আমরা বিপুল জনসংখ্যার ছোট একটি দেশ হয়েও সারা দেশে নিরবচ্ছিন্ন টিকা প্রদানে সক্ষম, তা বিশাল সাফল্যই বৈকি।
কিন্তু টিকাকে সত্যিকার অর্থে কার্যকর করার জন্য শুধু সরকারকে সর্বময় প্রস্তুতি নিলেই চলবে না, আমাদের জনগণেরও বেশ কিছু কাজ করার আছে। প্রথম কাজটিই হলো সুশৃঙ্খলভাবে টিকা নিতে কেন্দ্রে আসা। তার জন্য অনলাইনে ‘সুরক্ষা’ ওয়েবপেজে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। কাজটি একেবারেই সহজ। শুধু জাতীয় পরিচয়পত্র লাগে। বাংলাদেশের যে কোনো জায়গা থেকে নেট সংযোগ আছে এমন একটি কম্পিউটার বা স্মার্ট ফোন থেকেই রেজিস্ট্রেশন করা যায়। রেজিস্ট্রেশনের পর মোবাইলে দিন-তারিখ জানিয়ে একটি মেসেজ আসবে। সেটি এবং জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে নির্দিষ্ট তারিখে নির্দিষ্ট কেন্দ্রে যেতে হবে।
দ্বিতীয়ত, টিকা নেওয়ার জন্য মানুষেরও কিছুটা মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণের ব্যাপার আছে। কারণ আপনি যে টিকাটি নিচ্ছেন, তার জন্য আমরা অনেক দিন ধরে অপেক্ষায় ছিলাম, কবে টিকা আবিষ্কার হবে। তারপর অপেক্ষায় ছিলাম কবে আমাদের দেশে এই টিকা আসবে। সব দেশের মানুষই এরকম অপেক্ষায় ছিল। ফলে কেনার প্রতিযোগিতায় ছিল সব দেশ। তখন টিকা পাওয়া যাচ্ছিল না। এখনো অনেক দেশ টিকা সংগ্রহ করতে পারেনি। টিকা না পাওয়ার যে সংকট, তা তখন আরো বেশি ছিল। টিকার গবেষণা চলাকালীনই টিকা অগ্রিম কিনে নিচ্ছিল অনেক ধনী দেশ। আমরা ধনী না হয়েও কোন টিকাটা সফল হবে তা অনুমান করে টিকা আবিষ্কার সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই বুদ্ধি করে টিকা কিনে ফেলেছি। আজকে আমাদের ১০ কোটি ডোজ টিকা হাতে থাকার কারণ এটিই। বিশ্বের অনেক ল্যাব অগ্রিম বিক্রির টাকা নিয়েও টিকা এখনো আবিষ্কারই করতে পারেনি। ভাগ্যিস আমরা সেরকম কোনো ল্যাবে টাকা দিইনি। দিলে তো এখন অধিকাংশ বড়-ছোট দেশের মতো গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে হতো। এখন সরকার এই টিকা কিনে এনে আমাদের বিনা মূল্যে দিচ্ছে। এটিও আমাদের জন্য এক বিরাট প্রাপ্তি। নইলে এই টিকা অনেক টাকা খরচ করে আমাদের নিতে হতো। টিকা নেওয়ার সময় আমরা যেন মনে রাখি যে এটি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেক কষ্ট করে আবিষ্কার করতে হয়েছে এবং সরকারও অনেক কষ্ট করে এটি সংগ্রহ করেছে। তাহলে অপপ্রচারকারীদের অলীক কথাবার্তায় আর কোনো বিভ্রান্তি তৈরি হবে না।
তো এই টিকা নেওয়ার জন্য টিকা গ্রহীতার শারীরিক প্রস্তুতির ব্যাপারটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। মূল্যবান এই টিকা নেওয়ার পর আমার শরীর যেন এ থেকে সর্বোত্তম উপকার পেতে পারে, যেন আমার শরীরে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধব্যবস্থা, যাকে আমরা বলছি ইমিউনিটি, সর্বোচ্চ মাত্রায় গড়ে উঠতে পারে তার জন্য আমাদের শারীরিক প্রস্তুতির বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে সতর্ক করেছেন যে যাদের এই টিকার কোনো উপাদানে এলার্জি আছে, তারা যেন এই টিকা না নেন। আমাদের দেশে এটি প্রযোজ্য নয়, কারণ আমাদের খাদ্যাভ্যাস ও নৃতত্ত্ব। তাছাড়া যারা প্রথম ডোজ টিকা নেওয়ার পর মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া বা মারাত্মক এলার্জি দেখিয়েছেন, তাদের দ্বিতীয় ডোজ না নেওয়াই ভালো। সুখের বিষয়, এখনো বাংলাদেশে এরকম কোনো মারাত্মক প্রতিক্রিয়া কারো ক্ষেত্রে ঘটেনি। তবু সাধারণ পরামর্শ হচ্ছে, টিকা কেন্দ্রে টিকা নেওয়ার আগে আপনার কোনো খাবারে বা ওষুধে এলার্জি থাকলে তা সেখানকার ডাক্তারকে জানান। আপনার এসব কথা শোনার জন্য প্রতিটি টিকা কেন্দ্রেই ডাক্তার আছেন। তারা আপনার জন্য প্রয়োজনে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেবেন।
বিজ্ঞানীরা বলেন, টিকা নিলে সামান্য কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতেই পারে। মৃদু জ্বর, গায়ে ব্যথা, মাথাব্যথা, কাঁপুনি ইত্যাদি হলে বরং বুঝতে হবে যে টিকা শরীরে প্রার্থিত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছে। এসব লক্ষণ তারই বাহ্যিক প্রমাণ। তবে মারাত্মক কিছু হলে ডাক্তাররা অবশ্যই ব্যবস্থা নেবেন। তাই ভয়ের কোনো কারণ নেই।
এখন ঋতু পরিবর্তন হচ্ছে। আবহাওয়ার তাপমাত্রার ওঠানামার কারণে অনেকেই ঠান্ডা জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন। আপনার জ্বর থাকলে তা সেরে ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করাই উচিত। টিকা নেওয়ার আগের রাতে ভালো করে ঘুমান। একটা মধুর প্রশান্তির গভীর ও লম্বা ঘুম আপনার টিকাকে ইমিউনিটি গড়তে সাহায্য করবে। যাদের মদ্যপানের অভ্যাস আছে, তারা কয়েক দিন আগেই মদ খাওয়া থেকে বিরত থাকলে সবচেয়ে ভালো হয়।
যেদিন করোনার টিকা নেবেন, তার আগের কয়েক দিন কোনো ব্যথানাশক বা জ্বরনাশক ওষুধ, যেমন আইবোপ্রুফেন, প্যারাসিটামল ইত্যাদি খাবেন না। টিকা নেওয়ার পর যদি গা গরম বা গায়ে ব্যথা হয়, তাহলে কোনো হালকা ব্যথানাশক বা জ্বরনাশক ওষুধ, যেমন প্যারাসিটামল খেতে বিজ্ঞানীরা পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু যারা টিকা গ্রহণের আগে থেকেই এগুলো নিয়মিত ব্যবহার করেন, তাদের বলছি, বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। টিকা গ্রহণের আগেই এগুলো খেতে থাকলে সেই শরীরে টিকা তার ইপ্সিত ইমিউনিটি গড়ে তুলতে বাধার সম্মুখীন হয়। ফলে টিকার কার্যকারিতা কমে যেতে পারে। গত মাসে (জানুয়ারি ২০২১) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া ইর্ভিনও একই পরামর্শ দিয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কনট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনও এ প্রসঙ্গে গত মাসে টিকা নেওয়ার পরে যাতে ব্যথা বা জ্বর না হয়, তার জন্য প্রতিরোধক হিসেবে এগুলো ব্যবহার করতে মানা করে বলেছে, তবে টিকা নেওয়ার পরে এসব লক্ষণ দেখা দিলে খাওয়া যেতে পারে।
এসব মৃদু ব্যথানাশক বা জ্বরনাশক ওষুধ সাইক্লোঅক্সিজিনেজ-২ বা কক্স-২ নামের এনজাইমকে বাধা দেয়। কিন্তু এসব এনজাইম টিকা নেওয়ার পর শরীরে প্রচুর পরিমাণে বি-লিমফোসাইট তৈরিতে সাহায্য করে, যা শরীরে উচ্চমাত্রার ইমিউনিটি সৃষ্টিতে অবদান রাখে। তাই এই এনজাইমগুলোকে বাধা দিলে বা নষ্ট করলে শরীরে টিকা প্রত্যাশিত মাত্রায় কাজ করতে পারে না। টিকা নেওয়ার কয়েক দিন আগে থেকে তাই এসব ওষুধ সেবন বন্ধ রাখা উচিত। তবে টিকা নেওয়ার পরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার চিকিত্সা হিসেবে এগুলো খেলে তাতে টিকার কার্যকারিতা কমে যাওয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
২০১৫ সালে দেশব্যাপী ফ্লুর তীব্র প্রাদুর্ভাবের সময়ও ইউনিভার্সিটি অব রচেস্টার মেডিক্যাল সেন্টারের পরিচালক একই কথা বলেছিলেন যে, ফ্লুর টিকা নেওয়ার কয়েক দিন আগে থেকে এসব ওষুধ খাওয়া বন্ধ করা উচিত। কারণ এর ফলে টিকার কার্যকারিতা কমে যেতে পারে। ফ্লুর উদাহরণটি আনা হলো এ কারণে যে ফ্লু এবং কোভিডের মধ্যে শারীরবৃত্তীয় অনেক মিল রয়েছে।
তাই যা কিছু আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষা ক্ষমতা তথা ইমিউনিটিকে ধ্বংস করে, মহামারিকালে তার সবই ব্যবহারে অধিকতর সতর্কতা প্রয়োজন। বিশেষ করে মহামারি প্রতিরোধে টিকা নেওয়ার সময় তা আরো বেশি জরুরি।
লেখক: পরিচালক, বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার;
সাবেক ডিন, ফার্মেসি অনুষদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post