জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব.) ডা. আব্দুল মালিক
বোখারী শরীফের হাদীস হচ্ছে, ‘মানুষের শরীরে এক টুকরো মাংসপিণ্ড আছে, যা ভালো থাকলে সমস্ত শরীর ভালো থাকে আর তা দূষিত হয়ে পড়লে সমস্ত শরীর খারাপ হয়ে যায়। সেটা হলো ক্বালব।’ এর একটি অংশ হলো এনাটমিক্যাল হার্ট বা হৃৎপিণ্ড, অপরটি হলো হৃদয়। কিন্তু হৃৎপিণ্ড আর হৃদয় এক কিনা, তা নিয়ে আছে বিচিত্র অভিমত।
মানুষের জন্মরহস্য বেশ সূক্ষ্ম ও জটিল। শরীরের প্রতিটি কোষের মধ্যেই রয়েছে চেতনা এবং এতে প্রতিনিয়ত ভাঙাগড়া চলছে। মায়ের গর্ভে আমাদের যখন জন্ম হয় তখন তা প্রথমে একটিমাত্র কোষ থাকে। সেই কোষটি ভাগ হতে হতে একটি থেকে দুটি, দুটি থেকে চারটি— এভাবে নয় মাসে পুরো শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গড়ে ওঠে।
মানবশিশুর হৃৎপিণ্ড তৈরি হয় গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসে। একে বলা হয় মাস্টার অর্গান, কারণ হৃৎপিণ্ডই পুরো শরীরে রক্ত চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে। মাতৃগর্ভ থেকে শুরু করে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই অঙ্গ নিরলসভাবে কাজ করতে থাকে। কোনো কারণে যদি হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে যায় তাহলে আমাদের মৃত্যু ঘটে। শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গই আমাদের জন্যে জরুরি। হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, পাকস্থলী, বৃক্ক, যকৃৎ প্রত্যেকেই সুশৃঙ্খল ও সমন্বিতভাবে একটি সুনির্দিষ্ট নিয়মের মধ্য দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। ফলে সম্ভব হচ্ছে আমাদের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকা। আর এই সমন্বয়ের কাজটি সুন্দরভাবে পরিচালিত হচ্ছে আমাদের সচেতন চেষ্টা ছাড়াই।
আল্লাহ মানুষকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের শ্রেষ্ঠ প্রাণী হিসেবে সৃষ্টি করলেন, তারপর তাকে সবকিছু শিখিয়ে দিলেন। সেই মানুষ আজ তার উদ্ভাবিত প্রযুক্তির মাধ্যমে কত কী করছে! বিজ্ঞানীরা একে একে মহাবিশ্বের সৃষ্টিরহস্য উন্মোচন করছেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানের জগতেও ঘটে চলেছে অভাবনীয় সব পরিবর্তন। এখন হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা সম্ভব হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, যার শরীরে হার্ট প্রতিস্থাপন করা হলো তার মানসিকতা ও খাদ্যাভ্যাসে নানা পরিবর্তন আসে। এখানে সাম্প্র্রতিক একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য।
আট বছরের এক শিশুর হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্ট করার পর সে চিৎকার করে কিছু ঘটনা বলতে লাগল। সে পাগল হয়ে গেছে ভেবে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে। সাইকিয়াট্রিস্ট বললেন, শিশুটি যে-সব ঘটনা বর্ণনা করছে তার অনেক কথাই সত্য। অনুসন্ধানে দেখা গেল, যার হার্ট তার শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে সেই মেয়েটিকে হত্যা করা হয়েছিল। এ ঘটনার স্মৃতি ডোনারের হার্টের কোষে এমনভাবে রয়ে গেছে যে, এই শিশুটি খুন হওয়ার জায়গা এমনকি হত্যাকারীর নাম পর্যন্ত বলতে সক্ষম হলো। এর সূত্র ধরেই শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ল মূল হত্যাকারী!
তাই এখন ধারণা করা হচ্ছে, আমাদের হার্টেও রয়েছে একটি মিনিমাল ব্রেন, মাইনর বা লিটল ব্রেন, যার কারণে একজন ব্যক্তির হার্ট অন্যের দেহে প্রতিস্থাপন করায় তার অনেক পরিবর্তন হয় এবং অনেক কিছুই সে মনে করতে পারে। অর্থাৎ মানবদেহে হার্ট শুধু পাম্প করে না, বরং হার্টের সাথে মূল ব্রেন এবং হৃদয়েরও রয়েছে সংযোগ। অত্যন্ত মূল্যবান এ হার্টকে ভালো রাখতে হলে তাই আমাদেরকে কিছু নিয়ম অনুসরণ করতে হবে।
আল্লাহ তায়ালা সমস্ত কিছু তৈরি করে একটা নিয়মের মধ্যে রেখেছেন। এই নিয়মের মধ্যে মানুষ যদি ভালো কিছু করতে চায়, তার কাজ সহজ হবে। যেমন, কেউ যদি মনোযোগ ও সততার সাথে কাজ করে, সে সাফল্য পাবে। কাজ করবে না অথচ সাফল্য পেয়ে যাবে, তা হবে না।
তেমনি সুস্থ থাকতে হলেও প্রত্যেকেরই কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। আগের দিনে কলেরা বসন্ত ইত্যাদি সংক্রামক ব্যাধি দেখা যেত। আজকাল মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে হৃদরোগ ক্যান্সার ডায়াবেটিস ইত্যাদি অসংক্রামক ব্যাধিতে। আর একবার এ রোগগুলো কারো হয়ে গেলে তা একটি সচ্ছল পরিবারকেও অসচ্ছল করে ফেলে। সারাবিশ্বে এখন বলা হচ্ছে, ব্যক্তিগত পারিবারিক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে এ রোগগুলো থেকে মুক্ত থাকতে হবে। এই রোগগুলো অনেকটাই মানুষের নিজের সৃষ্টি। কোরআনে (সূরা রুম, আয়াত ৪১) যেমন বলা আছে, হে মানুষ! তোমাদের কর্মের প্রতিক্রিয়াতেই জলেস্থলে বিপর্যয় ও বালা-মুসিবত ছড়িয়ে পড়ে …। তেমনি এ রোগগুলোও আমাদের ভুল খাদ্যাভ্যাস এবং অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের কারণে এত বাড়ছে।
আমরা এখন ফাস্টফুডসহ নানা কুখাদ্য খাচ্ছি। ব্যায়াম করছি না। কিন্তু নিজেকে সুস্থ রাখতে হলে সঠিক খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করতে হবে। শাকসবজি ও দেশীয় ফলমূল খেতে হবে। মাংস ও চর্বিজাতীয় খাবার যতদূর সম্ভব কমিয়ে দিতে হবে। লবণ বেশি খেলে উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। আর ধূমপান, জর্দা, সাদা পাতা খাওয়া থেকে বিরত থাকলে অনেক রোগ থেকে বেঁচে যাবেন। সেইসাথে নিয়মিত ব্যায়ামচর্চা ও হাঁটার অভ্যাস করুন। অফিসে যাওয়ার সময় বা বাসায় ফেরার সময় হাঁটুন। সম্ভব হলে লিফট ব্যবহার না করে হেঁটে ওপরে উঠুন।
আসলে রোগ প্রতিরোধের দিকে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে। যদি পেটে ব্যথা হয় একজন মানুষ ডাক্তারের কাছে যাবে, পয়সা দেবে, ওষুধও খাবে। কিন্তু পেটে ব্যথা না হওয়ার পরামর্শ যদি দেয়া হয়, সেটা সাধারণত মানুষ শুনতে চায় না। এ মানসিকতার কারণেই তরুণ প্রজন্মের মাঝেও এখন হৃদরোগের প্রভাব দেখা যাচ্ছে।
মানুষের মন খুব চঞ্চল, সারাদিন বিভিন্ন চিন্তার মধ্যে থাকে। বিশেষ করে অতীতের চিন্তা বেশি করে। কিন্তু বর্তমানই হলো আসল। এখন যদি কাজ করেন, তাহলে ফল পাবেন। মানুষের মঙ্গলের জন্যে মনোযোগ দিয়ে কাজ করলে বরকত আসবে। দক্ষতা সৃষ্টি হবে। যিনি যে পেশায় থাকুন, তিনি যদি আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রেখে সততার সাথে কাজ করেন, তাহলে অবশ্যই তিনি সফল হবেন।
আরেকটা কথা হলো, সাফল্য এলে গর্ব করা ঠিক নয়। আল্লাহ বলেছেন তাঁর ওপর নির্ভর করতে। কাজেই সবসময় নির্ভর করবেন আল্লাহর ওপরে। আসল শক্তি ওখানে। যত শক্তি মমতা বুদ্ধিমত্তা সব আসে ওখান থেকেই। আর শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলে হবে না, অন্যের মঙ্গলের জন্যে যার যার অবস্থান থেকে সর্বতোভাবে আমাদের চেষ্টা করতে হবে।
Discussion about this post