হার্টবিট ডেস্ক
গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার কথা জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সে দিন দুপুরের পর গণমাধ্যমে প্রকাশিত ওই খবরে স্তব্ধ হয়ে যায় গোটা দেশ। ভয়াল এ খবরে কেঁপে ওঠে সবার হৃদয়।
প্রাণঘাতী করোনা পরিস্থিতিতে সব কিছুতে নেমে আসে অস্বাভাবিকতা। কিন্তু দেশপ্রেমে উজ্জীবিত সম্মুখযোদ্ধা চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরলস চেষ্টা ও পরিশ্রমের কল্যাণে তখনও সদর্পে চলতে থাকে দেশের স্বাস্থ্যখাত।চিকিৎসক, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্টসহ হাসপাতালের সকল কর্মীই ছিলো করোনা যুদ্ধের প্রথম সারির সৈনিক।
ওই সময় থেকে কোভিড, নন-কোডিভ সকল রোগীকে দিন-রাত চিকিৎসা সেবা দিয়ে অন্যের জীবন বাঁচাতে গিয়ে ঝুঁকিতে ফেলে দেন নিজের ও সজনের জীবন।
অদৃশ্য শত্রুর মোকাবিলায় চিকিৎসকরা
দুর্বিসহ ওই সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, কোনো প্রস্তুতি বা পূর্বপরিকল্পনা ছাড়া একটি অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে চিকিৎসকরা। শুরুতে বেশ কিছু ঘাটতি ছিল। রোগ নির্ণয়ে ঘাটতি ছিল। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা কম থাকার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে তারা অভ্যস্ততা ছিল না। চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতালে ছিল সমন্বয়হীনতা। চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ ও নার্সদের প্রস্তুত করা ছিল চ্যালেঞ্জ। অক্সিজেন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ও ভ্যান্টিলেটরের ব্যবস্থা করাও ছিল কঠিন। চিকিৎসকদের জন্য গাইডলাইন তৈরি করা ছিল আরেকটি চ্যালেঞ্জ।’
পিপিই সংকটে তটস্থ স্বাস্থ্যকর্মীরা
ভয়াবহ দিনগুলোর বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘শুরুতে সুরক্ষার কিছুটা ঘাটতি থাকায় চিকিৎসক-নার্সরা রোগীর কাছে যেতে খানিকটা ভয় পেতেন। এমনকি করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিকে সজনেরা দেখতে যেতে পারতেন না। সীমিত সংখ্যক মানুষ জড়ো হয়ে কবর দিতেন, না হয় অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের নিজেদের রীতি অনুযায়ী শেষকৃত্য সম্পন্ন করতেন।
চলে গেলেন ১২৯ চিকিৎসক
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে বিগত এক বছরে প্রাণ হারান শতাধিক চিকিৎসক। গত ২১ জানুয়ারি বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ)তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত চিকিৎসক ১২৯ জন চিকিৎসক করোনায় প্রাণ হারিয়েছেন।
এর মধ্যে রয়েছেন নবীন চিকিৎসক থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, যাদের শূন্যতা আগামী ৫০ বছরেও পূরণ হওয়ার নয়।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) সূত্রে জানা যায়, দেশে সর্বপ্রথম ১৪ এপ্রিল সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডাক্তার মঈন উদ্দিন আহমেদ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন ঢাকার একটি হাসপাতালে। তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ৪৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন।
এ সংগঠনের হিসাব মতে, আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি। এরপরে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অবস্থান।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, চলতি বছর করোনায় চিকৎসকের মৃত্যুতে স্বাস্থ্যখাতের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। এদের বেশির ভাগ প্রবীণ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন।
অধ্যাপক খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, চিকিৎসকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাসপাতালে গিয়ে রোগীদের চিকিৎসা করেছেন। এটা করতে গিয়ে অনেক চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা মারা গেছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের চিকিৎসকরা প্রমাণ করেছেন, দেশের মানুষের জন্য তারা প্রতিমুহূর্তে প্রস্তুত। প্রমাণ হয়েছে, তারা কতটা ঐক্যবদ্ধ এবং এ দেশের মানুষের জন্য নিবেদিত।’
এ ছাড়া চারজন নার্স, একজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
কমে আসছে সংক্রমণ
শীত মৌসুমে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল বিশেষজ্ঞসহ সকল মহলে। তবে সে আশঙ্কা দূর করে চলতি বছরের প্রথম মাস থেকেই কমতে শুরু করেছে সংক্রমণের হার। একই সঙ্গে কমেছে মৃত্যুর হারও।
সংক্রমণের দশম মাসে চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি দেশে প্রথম করোনা শনাক্তের হার ৬ শতাংশের নিচে নেমে আসে। অর্থাৎ সেদিন পরীক্ষা অনুপাতে রোগী শনাক্তের হার ছিল ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে নমুনা পরীক্ষার হার চার দশমিক ৩০ শতাংশ। এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ২৭ শতাংশ এবং শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৯১ দশমিক ৪০ শংতাশ। শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুর হার এক দশমিক ৫৪ শতাংশ।
চিকিৎসক এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য কর্মীগণ তারা নিজেদের জীবন বাজি রেখে এবং তাদের পরিবারবর্গকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়ে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির সেবা করে যাচ্ছেন। তাঁদের এমন মহান আত্মত্যাগকে আমরা শ্রদ্ধার সাথে মূল্যায়ন করি।
Discussion about this post