ডা. গোবিন্দ চন্দ্র রায়, সহযোগী অধ্যাপক, সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল
হার্টের ভেতরে রক্ত চলাচল নিয়ন্ত্রণ করার জন্য চারটি ভালভ বা কপাটিকা থাকে। এগুলোর মাধ্যমেই মূলত হার্টের ভেতরে কার্বন ডাই-অক্সাইডযুক্ত রক্তের সঙ্গে অক্সিজেনযুক্ত রক্তের মিশ্রণ ঠেকানো হয়। এই ভালভ বা কপাটিকাগুলোর একটিতে বা একাধিকটিতে যদি কোনো সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে হার্টের কাজেও ব্যাঘাত ঘটে, শরীরে অনেক লক্ষণও প্রকাশ পায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে হার্টের ভালভজনিত সমস্যা হয় জন্মগত কারণে, কিছু হয় অন্যান্য কারণে। বৃদ্ধ বয়সেও ভালভে চর্বি ও ক্যালসিয়াম জমে এর কার্যকারিতা নষ্ট করে দিতে পারে।
লক্ষণ
♦ দ্রুত শ্বাস নেওয়া, সহজেই হাঁপিয়ে যাওয়া, শ্বাস ধরে রাখতে কষ্টবোধ। এ ধরনের সমস্যা বেশি হয় সাধারণ কাজকর্মে, এমনকি শুয়ে-বসে থাকলেও।
♦ ঘুমাতে অসুবিধা হয়। রোগী শ্বাস নিতে অসুবিধাবোধ করে বলে ঘুমের সময় একাধিক বালিশ ব্যবহার করে মাথা উঁচু করে রাখার চেষ্টা করে। এতে সে নিঃশ্বাস নিতে পারে; কিন্তু আরামে ঘুমাতে পারে না।
♦ সাধারণ কাজেও শরীরে যথেষ্ট শক্তি পাওয়া যায় না। সব সময় দুর্বলতাবোধ হয়। মাথা ঝিমঝিম করে। অনেক সময় রোগী কিছু সময়ের জন্য অজ্ঞানের মতো হয়ে যায়।
♦ বুকে মাঝেমধ্যে অস্বস্তিবোধ হয়। অনেক সময় চাপচাপ বোধ হয়। অনেক সময় বুকের ভেতরে ভারী ভারী লাগে।
♦ বুক ধড়ফড় করে। কখনো কখনো হূত্স্পন্দন দ্রুততর হয়। কখনো হূত্স্পন্দন একবার বা দুইবার মিস হয় বা বাদ যায়।
♦ পায়ের গোড়ালি, পায়ের পাতা ও তলপেটে অনেকের পানি জমে। এতে অনেকের শরীরের ওজন দ্রুত বেড়ে যায়।
তবে মনে রাখা দরকার, লক্ষণ বেশি প্রকাশ পেলেই যে রোগের প্রকোপ বেশি—সব সময় তেমন না-ও হতে পারে। অনেক সময় অল্প লক্ষণ প্রকাশ পায় কিংবা লক্ষণ প্রায় থাকেই না; কিন্তু হার্টের ভালভে বড় ধরনের সমস্যা থাকতে পারে।
কী ধরনের সমস্যা হয়?
হার্টের ভালভজনিত অসুখের কয়েকটি ধরন আছে। সাধারণত দুটি বড় ভাগে এই ধরনগুলোকে আলাদা করা হয়। ভালভুলার স্টেনসিস ও ভালভুলার ইনসাফিসিয়েন্সি। স্টেনসিস সমস্যা তখন হয়, যখন ভালভগুলো পরিপূর্ণভাবে খুলতে পারে না। এ কারণে হার্ট ফেইলিওরসহ আরো কিছু হার্টের সমস্যাও হতে পারে। আর ভালভুলার ইনসাফিসিয়েন্সিতে ভালভ যথাযথভাবে বন্ধ হতে পারে না। ফলে হার্ট যখন রক্ত পাম্প করে, তখন কিছু রক্ত ভালভের ভেতর দিয়ে উল্টোপথে প্রবাহিত হয়। এ জন্য রক্ত পাম্প করতে হার্টকে অতিরিক্ত কাজ করতে হয়।
কেন ভালভের অসুখ হয়?
♦ জন্মগতভাবে যাদের হার্টের ভালভে সমস্যা হয়, দেখা যায়, তাদের ক্ষেত্রে অ্যাওর্টিক ও পালমোনারি ভালভ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত থাকে।
♦ সাধারণত ভালভে তিনটি পাতার মতো থাকে। কোনো কারণে একটি পাতার মতো অংশ না থাকলে বাইকাসপিড অ্যাওর্টিক ভালভে সমস্যা দেখা দিতে পারে। এতে ভালভ ঠিকভাবে খুলতে বা বন্ধ হতে পারে না। এটিও সাধারণত জন্মগত কারণে হয়।
♦ জন্মের পরেও কিছু কারণে হার্টের ভালভ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যেমন—রিউমেটিক ফিভার বা বাতজ্বর থেকে, ব্যাকটেরিয়ার এনডোকার্ডাইটিস থেকে।
♦ রিউমেটিক ফিভার বা বাতজ্বর এক ধরনের ব্যাকটেরিয়াজনিত ইনফেকশন, যা গলাব্যথা দিয়ে শুরু হয়। যদি গলাব্যথার চিকিৎসায় যথাযথ অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা না হয়, তাহলে একই ব্যাকটেরিয়া হার্ট ভালভের ক্ষতি করে।
♦ ব্যাকটেরিয়াল এনডোকার্ডাইটিস হয় সাধারণত রক্তে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার প্রবেশের মাধ্যমে যখন হার্টের চারপাশে থাকা মাংসপেশিতে প্রদাহ করে তখন। এ জীবাণু হার্টে যেতে পারে মাড়ির প্রদাহ বা জিনজিভাইটিস থেকে, স্যালাইন প্রয়োগের সময়, অন্যান্য কিছু ইনফেকশন থেকে।
♦ হার্টের ভালভের ক্ষতি হয় এমন কিছু অসুখের মধ্যে আছে করোনারি আর্টারি ডিজিজ, হার্ট অ্যাটাক, কার্ডিওমায়োপ্যাথি, সিফিলিস, উচ্চ রক্তচাপ, অ্যাওর্টিক অ্যানিওরিসম, কানেকটিভ টিস্যু ডিজিজ ইত্যাদিতে।
♦ ক্যান্সার, সিস্টেমিক লাপাস ইরাইথ্রোম্যাটোসিস ইত্যাদি কারণেও হার্টের ভালভের অসুখ হতে পারে।
বাচ্চাদের সমস্যা বোঝার উপায়
বাচ্চাদের এই সমস্যা জন্মগতভাবে থাকলে সে ক্ষেত্রে খুব একটা লক্ষণ থাকে না। তবে যদি কোনো বাচ্চা রিউম্যাটিক ফিভারে আক্রান্ত হয়ে অ্যাকিউট কার্ডাইটিসে আক্রান্ত হয়, তখন লক্ষণ হিসেবে বুকে ব্যথা, বুক ধড়ফড় ইত্যাদি থাকতে পারে। অনেক সময় নিচের কিছু লক্ষণ দেখেও শিশুর হার্ট ভালভের সমস্যা অনুমান করা যায়। যেমন—
♦ পায়ের ও হাতের গিঁট ব্যথা ও ফুলে যাওয়া
♦ জ্বর হওয়া
♦ অস্বাভাবিক আচরণ
চিকিৎসা
হঠাৎ আক্রান্ত বা অ্যাকিউট কার্ডাইটিস হলে প্রথমে রিউমেটিক ফিভারের চিকিৎসা দেওয়া হয়। আর দীর্ঘদিন ধরে আক্রান্ত থাকলে বা ভালভ জন্মগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে সার্জারির মাধ্যমে ভালভ ঠিক করে দেওয়া বা রিপেয়ার কিংবা রিপ্লেস বা প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হতে পারে।
কেমন খরচ পড়ে?
রিউম্যাটিক ফিভারের জন্য কার্ডাইটিস হলে শুধু মুখে সেবনযোগ্য পেনিসিলিন, কখনো কখনো অল্প সময়ের জন্য স্টেরয়েড এবং অ্যাসপিরিন প্রয়োগে চিকিৎসা করতে হয়। এর খরচ খুবই কম।
তবে সার্জারি করে ভালভ পরিবর্তন বা মেরামত করতে হলে বা প্রতিস্থাপন করতে হলে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালভেদে ১০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ পড়তে পারে।
প্রতিস্থাপনই সব নয়, নিয়মকানুন মানতে হয়
♦ নিয়মিত ফলোআপে আসতে হয়। মেটালিক ভালভ প্রতিস্থাপন করলে বাকি জীবন ওয়ারফেরিন ওষুধ সেবন করতে হয়।
♦ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক অথবা অন্য কোনো ওষুধ সেবন করা যায় না।
♦ ওয়ারফেরিন ওষুধ সেবন করতে হয় বলে অনেক ধরনের খাবার পরিহার করতে হয়।
♦ যদি টিস্যু টাইপ ভালভ প্রতিস্থাপন করা হয়, তবে সার্জারির পর তিন মাস ওয়ারফেরিন সেবন করতে হয়।
♦ ভালভ সার্জারির পরও যদি কারো দীর্ঘদিন জ্বর থাকে, তবে এন্ডোকার্ডাইটিসজনিত সমস্যা কি না তা নির্ণয় করে দ্রুত চিকিৎসা নিতে হয়।
Discussion about this post