হার্টবিট ডেস্ক
বাংলাদেশে নির্দিষ্ট রক্তের গ্রুপ ও বিসিজি টিকার সঙ্গে করোনা রোগীদের কোনও সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে দাবি করেছেন চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজসহ সাতটি প্রতিষ্ঠানের গবেষকরা। রবিবার (১০ জানুয়ারি) গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।গবেষকদের মতে, বাংলাদেশে উপসর্গহীন করোনা সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। অপরদিকে সংক্রমণমুক্ত হওয়ার পর কোভিড-পরবর্তী স্মরণশক্তির দুর্বলতা, শারীরিক ব্যথা এবং ঘুমে ব্যাঘাতসহ বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছেন আক্রান্তদের একটা বড় অংশ। দেশে কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৯০ ভাগেরই ইতোপূর্বে সবক’টি টিকা নেওয়া আছে।
গবেষকরা জানান, এসব তথ্য পাওয়া গেছে আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা এলসেভিয়ারের অন্তর্ভুক্ত এবং ফ্রান্স থেকে প্রকাশিত গবেষণা সাময়িকী ‘নিউ মাইক্রোবস অ্যান্ড নিউ ইনফেকশন’-এর সাম্প্রতিক প্রবন্ধে। দেশে করোনার হটস্পট ঢাকা, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত এক হাজার ২১ জন রোগীর ওপরে পরিচালিত এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. এইচ এম হামিদুল্লাহ মেহেদী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক ড. আদনান মান্নান, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক ফারহানা আক্তার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক ড. মুশতাক ইবনে আয়ুব। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের দায়িত্বে ছিলেন স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. নঈম উদ্দিন হাছান চৌধুরী। গবেষণা তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে ছিলেন রোগতত্ত্ববিদ ডা. মো.ওমর কাইয়ুম, ঢাকা মহানগর হাসপাতালের করোনা ইউনিটের ডা. সানজিদা হোসেন, ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের ডা. প্রসূন বিশ্বাস ও চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. আবদুর রব মাসুম।
গবেষণায় দেখা যায়, উপসর্গযুক্ত রোগীদের মধ্যে অর্ধেকেরই ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। আক্রান্তদের ৭৫ ভাগই পুরুষ এবং ৩০-৩৯ বছর বয়সের মানুষ সবচেয়ে বেশি (৩০ শতাংশ)। আক্রান্তদের মধ্যে ৩০ শতাংশের বেশি রোগীর উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ডি ডাইমার এবং ফেরিটিন বেড়ে যায়। কোভিড থেকে সুস্থ হওয়ার চার সপ্তাহ পরেও আক্রান্তদের এক-চতুর্থাংশের মধ্যে ব্যথা, শারীরিক দুর্বলতা, বিষণ্নতা ও নিরবচ্ছিন্ন ঘুম বাধাগ্রস্ত হতে দেখা গেছে। ৭০ ভাগ রোগীর চিকিৎসাতেই অ্যাজিথ্রোমাইসিন বা জিম্যাক্স এবং ৪৫ ভাগের ক্ষেত্রে ডক্সিসাইক্লিন ব্যবহৃত হয়েছে। শ্বাসকষ্টের রোগীদের মধ্যে কোভিড থেকে সুস্থ হওয়ার পরেও উল্লেখযোগ্য হারে স্মরণশক্তি কমে যাওয়া, মনোসংযোগ কমে যাওয়া, বিভিন্ন অঙ্গে ব্যথা ও ঘুমের সমস্যা পরিলক্ষিত হয়েছে। এপ্রিল থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত প্রায় দেড়গুণ করে বেড়েছে প্রতিমাসে উপসর্গহীন রোগীর সংখ্যা।
এ প্রসঙ্গে গবেষক দলের অন্যতম প্রধান ডা. হামিদুল্লাহ মেহেদী বলেন, ‘এই গবেষণায় কোভিড-পরবর্তী প্রতিক্রিয়াকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে এবং দেখা গেছে, দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভোগা মানুষজন বেশি ঝুঁকির মুখে থাকে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে আমাদের এই গবেষণার ফল সামঞ্জস্যপূর্ণ। এছাড়া, গবেষণায় কোভিড পরবর্তী জটিলতার যে চিত্র পাওয়া গেছে, তা ভবিষ্যতে এ রোগ থেকে সেরে ওঠা মানুষজনের অন্যান্য রোগের ধরন অনুসরণে সহায়ক হবে।’
গবেষণায় আরও উঠে আসে যে দেশে কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৯০ ভাগেরই এর আগে সবক’টি টিকা নেওয়া আছে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন বি পজিটিভ (৩৬ শতাংশ) এবং ও পজিটিভ (২৯ শতাংশ) ব্লাড গ্রুপের রোগীরা। করোনার আগে যারা দীর্ঘমেয়াদি ওষুধ গ্রহণ করছিলেন, তাদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে কোভিড পরবর্তী জটিলতা। এছাড়া, যাদের দীর্ঘমেয়াদি রোগ আছে, যেমন- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট ও হৃদরোগ—তাদের কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার হার এবং কোভিড পরবর্তী জটিলতার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেশি পাওয়া গেছে। রোগীদের অর্ধেকেরই পরিবারের বা বাইরের কোনও কোভিড আক্রান্ত রোগীর সঙ্গে আক্রান্ত হওয়ার আগে এক সপ্তাহের মধ্যে দেখা হয়েছে এবং মাত্র পাঁচ ভাগের বিদেশফেরত কোনও ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আদনান মান্নান বলেন, ‘ইতোপূর্বে আরেকটি গবেষণায় ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, অন্যান্য দেশে যেভাবে নির্দিষ্ট কিছু রক্তের গ্রুপের মানুষের কোভিড হবে বা বেশি আক্রান্ত হবে, এমন তথ্য দেওয়া হয়েছে, আমাদের দেশে তেমন কোনও সুনির্দিষ্ট সম্পর্ক পাওয়া যায়নি।’
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের ডা. ফারহানা আক্তার বলেন, ‘বিসিজি টিকা কোভিড থেকে সুরক্ষা দিতে পারে, এরকম কোনও শক্ত প্রমাণ আমরা দেখতে পাইনি। এছাড়া ভবিষ্যতে সুস্থ রোগীদের অ্যান্টিবডির মাত্রা নিয়ে তথ্য প্রয়োজন। তবে আরও অনেক বেশি রোগীর (অন্তত এক লাখ) ওপরে গবেষণা পরিচালিত হওয়া উচিত।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মুশতাক ইবনে আয়ুব বলেন, ‘দেশে উপসর্গবিহীন রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। তাদের নমুনা বিশ্লেষণ করে দেখা উচিত কোনও নতুন প্রজাতির বা ভিন্ন ধারার জিনগত গঠনের করোনাভাইরাসের উপস্থিতি এর পেছনে দায়ী কিনা।’
গবেষণার সামগ্রিক তত্ত্বাবধানে ছিল ‘ডিজিজ বায়োলজি অ্যান্ড মলিকুলার এপিডেমিওলজি রিসার্চ গ্রুপ, চট্টগ্রাম’।
Discussion about this post