ডঃ তারেক আনোয়ার
সিজোফ্রেনিয়া ব্রেইনের দুরারোগ্য একটা ব্যাধি। এটা একজন মানুষ কিভাবে চিন্তা এবং কাজ করে, কিভাবে আবেগ প্রকাশ করে, কিভাবে বাস্তবতাকে বোঝে, তা পরিবর্তন করে দেয়। সিজোফ্রেনিয়া তে আক্রান্ত অনেক মানুষের সমাজে – স্কুলে, অফিসে, পারিবারিক সম্পর্কে – মেলামেশা অসম্ভব হয়ে পড়ে। রোগীরা সবসময় ভয়ে ভয়ে এবং পশ্চাত্পদে থাকে।
সিজোফ্রেনিয়া সম্পুর্ণ নিরাময় করা যায় না, তবে সঠিক চিকিৎসার দ্বারা এটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
সিজোফ্রেনিয়া হলে অনেকে মনে করে রোগীর মাল্টিপল পার্সোনালিটি (একই লোকের চরিত্রে একাধিক ব্যক্তিত্ব) তৈরি হয়। এটা ভুল ধারণা। সিজোফ্রেনিয়া একটা মনোব্যাধি যেটা হলে মানুষ বুঝতে পারে না কোনটা সত্যি আর কোনটা কল্পনা। কিছু কিছু সময় রোগী বাস্তবতার সঙ্গে সম্পূর্ণ স্পর্শ হারায়। পুরো পৃথিবীটা তাদের কাছে বিভ্রান্তিকর চিন্তা, ছবি এবং শব্দ মনে হয়। রোগীর হঠাৎ করে পার্সোনালিটি (ব্যক্তিত্ব) এবং ব্যবহার বদলানো কে সাইকোটিক এপিসোড বলা হয়। বাস্তবতার সঙ্গে স্পর্শ হারালে এটা হয়।
সিজোফ্রেনিয়া এর মারাত্মক অবস্থা একেক জনের একেক রকম হয়। কিছু কিছু মানুষের জীবনে একবার সাইকোটিক এপিসোড হয়। কারো কারো এটা বেশ কয়েকবার হতে পারে এবং তারা এপিসোড এর মধ্যবর্তী সময়গুলোতে মোটামুটি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। অন্যরা প্রত্যেক এপিসোড এর পরে ভালোভাবে সুস্থ হয় না এবং তাদের অসুস্থতা বাড়তে পারে।
এক সময়ে ডাক্তাররা সিজোফ্রেনিয়া কে কয়েকটা উপশাখায় ভাগ করতেনঃ
- Paranoid: রোগীর মনে হয় তার উপর অত্যাচার করা হচ্ছে কিংবা তাকে অন্যরা গোপনে দেখছে।
- Disorganized: রোগীকে দেখে বিভ্রান্ত মনে হয়।
- Catatonic: রোগী অনড় হয়ে থাকে কিংবা কথা বলতে না পারে।
- Undifferentiated schizophrenia: একটা উপশাখা যেটাতে কোনো Paranoid, Disorganized এবং Catatonic উপশাখার বৈশিষ্ঠগুলো লক্ষনীয় না।
- Residual Schizophrenia: যখন সাইকোটিক লক্ষণগুলো কমতে থাকে কিংবা আর দেখা যায় না।
বিজ্ঞানীরা এখন মনে করেন উপরের উপশাখাগুলো আগে যতটা নির্ভুল এবং উপযোগী মনে করা হত, ততটা নির্ভুল এবং উপযোগী না। তাই তারা এখন শুধুমাত্র উপসর্গ এবং উপসর্গের মারাত্মকতার উপর নির্ভর করে।
সিজোফ্রেনিয়া এর উপসর্গগুলো কি কি?
সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত রোগীদের বেশ কয়েকটা উপসর্গ দেখা দিতে পারে। তাদের চিন্তা, ক্রিয়া, ব্যবহার, ও পার্সোনালিটিতে পরিবর্তন আসতে পারে এবং তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম ব্যবহার করতে পারে। যখন এই রোগটি প্রথম প্রথম হয়, তখন লক্ষনগুলি আকস্মিকভাবে দেখা দেয় এবং গুরুতর হয়।
সিজোফ্রেনিয়া এর কমন উপসর্গগুলোকে তিনটি বিভাগে – পজিটিভ উপসর্গ, কগনিটিভ উপসর্গ এবং নেগেটিভ উপসর্গে – ভাগ করা যায়।
সিজোফ্রেনিয়া এর পজিটিভ উপসর্গ
এখানে পজিটিভ দিয়ে “ভালো” বোঝানো হচ্ছে না। বরং অতিরঁজিত চিন্তাভাবনা এবং ব্যবহার যেটা বিচারশক্তিহীন হয়ে যায় সেটা বোঝানো হচ্ছে। এগুলোকে মাঝেমধ্যে সাইকোটিক উপসর্গও বলা হয়। এই উপসর্গগুলো হচ্ছেঃ
Delusions: Delusions হচ্ছে অদ্ভুত বিশ্বাস যার সাথে বাস্তবতার কোন সম্পর্ক নেই। Delusion এ আক্রান্ত ব্যাক্তিদের বাস্তবিক তথ্য দেওয়া হলেও তাদের বিশ্বাসের পরিবর্তন হয় না। কিছু উদাহরণ – Delusion এ আক্রান্ত ব্যাক্তি বিশ্বাস করতে পারে যে, অন্যান্য মানুষ তার চিন্তা শুনতে পারছে, অথবা মানুষ তার মাথায় ভুল চিন্তা-ভাবনা ঢুকাচ্ছে, অথবা মানুষ তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে।
Hallucinations: Hallucination এ আক্রান্ত ব্যাক্তি অবাস্তব জিনিস অনুভব করে। তারা বাস্তব না এমন জিনিস দেখতে পেতে পারে, শব্দ শুনতে পেতে পারে, অদ্ভুত গন্ধ পেতে পারে, অথবা শরীরে কোন জিনিস লেগে না থাকলেও কিছু একটা শরীর স্পর্শ করছে এমন মনে করতে পারে।
Catatonia: রোগী দীর্ঘ সময় ধরে একটা জায়গা থেকে সরার শারীরিক শক্তি হারায়।
ডিসঅর্গানাইজড উপসর্গ হচ্ছে এক ধরণের পজিটিভ উপসর্গ যেটা আক্রান্ত ব্যাক্তির ঠিকভাবে চিন্তা করা এবং সাড়া দেয়ার অক্ষমতাকে প্রতিফলিত করে। ডিসঅর্গানাইজড উপসর্গের কয়েকটা উদাহরণ হচ্ছেঃ
- কথায় আবোল-তাবোল শব্দ ব্যবহার করা এবং এমনভাবে বাক্য তৈরি করা, যেটা অন্যান্যরা ঠিকভাবে বুঝতে পারে না
- খুব দ্রুত চিন্তা বদলানো
- সিদ্ধান্ত নিতে না পারা
- অতিরিক্ত অর্থ ছাড়া জিনিস লেখা
- দ্রুত ভুলে যাওয়া অথবা জিনিসপত্র হারানো
- চলাফেরা অথবা অঙ্গভঙ্গির পুনরাবৃত্তি করা
- দৈনন্দিন দৃষ্ট বস্তু, শব্দ এবং অনুভূতি ঠিক মতো বুঝতে না পারা
সিজোফ্রেনিয়া এর কগনিটিভ উপসর্গ
- কগনিটিভ উপসর্গের কয়েকটা উদাহরণ হচ্ছেঃ
- ঠিকমতো তথ্য বুঝে, চিন্তাকরে কাজ করতে না পারা
- মনোযোগ দিতে না পারা
- কোনো তথ্য মুখস্থ করার সাথে সাথে সেটা কোন কাজে ব্যবহার করতে না পারা
সিজোফ্রেনিয়া এর নেগেটিভ উপসর্গ
এখানে নেগেটিভ দ্বারা “খারাপ” বোঝানো হয় না। বরং সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত ব্যাক্তির সাধারণ কিছু ব্যবহারের অনুপস্থিতিকে বোঝানো হয়। সিজোফ্রেনিয়া এর নেগেটিভ উপসর্গের কয়েকটা উদাহরণ হচ্ছেঃ
- আবেগের অনুপস্থিতি অথবা খুব সীমিত পরিসীমার আবেগ
- পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবের সাথে না মেশা এবং সামাজিক ক্রিয়াকালাপে অংশগ্রহণ না করা
- শক্তি হ্রাস পাওয়া
- কথাবার্তা কমে যাওয়া
- অনুপ্রেরণার অভাব
- জীবনের প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়া
- শরীরের যত্ন না নেওয়া
সিজোফ্রেনিয়া হওয়ার কারন
সিজোফ্রেনিয়া হওয়ার সঠিক কারণটা বিজ্ঞানীদের জানা নেই। তবে ক্যান্সার এবং ডায়াবেটিস এর মতো সিজোফ্রেনিয়া এর জৈবিক ভিত্তি আছে। গবেষকরা সিজোফ্রেনিয়া হওয়ার পিছনে ভুমিকা পালন করে এমন কয়েকটা ফ্যাক্টরকে উন্মোচিত করেছেনঃ
- জেনেটিক্স (বংশগত): বাবা/মা’র এই রোগ থাকলে সন্তানের এটা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
- ব্রেইন কেমিস্ট্রি এবং সার্কিটসঃ এই রোগ থাকা মানুষের ব্রেইনে কিছু কেমিকেল অনিয়মিত থাকতে পারে যেটা চিন্তা এবং আচরণের উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
- ব্রেইনের অস্বাভাবিকতা: গবেষণায় Schizophrenia তে আক্রান্ত মানুষের ব্রেইনে কিছু অস্বাভাবিক গঠন খুজে পাওয়া গিয়েছে। তবে এই অস্বাভাবাকিতা Schizophrenia তে আক্রান্ত সকল মানুষের থাকে না এবং এই রোগে আক্রান্ত না এমন মানুষেরও এই অস্বাভাবিকতা থাকতে পারে।
- পরিবেশগত কারণঃ ভাইরাস সংক্রমণ, টক্সিনের আশেপাশে সময় ব্যায় করা, অত্যন্ত চাপগ্রস্থ পরিস্থিতি ইত্যাদির কারণে Schizophrenia হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। শরীর যখন হরমোন অথবা শারীরিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায় – যেমন কিশোর বয়স – তখন Schizophrenia এর উপসর্গ দেখা দেয়ার সম্ভাবনা বেশি।
কাদের সিজোফ্রেনিয়া হয়?
সিজোফ্রেনিয়া যে কোনো মানুষের হতে পারে। এটা সারা পৃথিবীর সব জায়গায়, সব জাতি এবং সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে দেখা যায়। নারী এবং পুরুষ উভয়েরই এটা সমানভাবে হয়। যদিও এটা সব বয়সেই হতে পারে, সিজোফ্রেনিয়া এর উপসর্গ সাধারণত পুরুষদের কিশোর বয়সে অথবা ২০-২২ বছর বয়সে এবং নারীদের ২৫-৩৫ বছর বয়সে প্রথম দেখা দেয়।
যদি সিজোফ্রেনিয়া অল্প বয়সে হয় তাহলে বয়স বেশি হলে এটা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। ৫ বছরের বেশি বয়সী বাচ্চাদের এটা হতে পারে। তবে কৈশোরের আগে এটা হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম।
সিজোফ্রেনিয়া কিভাবে নির্ণয় করা হয়?
যদি সিজোফ্রেনিয়া এর উপসর্গ দেখা যায় তাহলে ডাক্তার রোগীর সম্পূর্ণ মেডিকেল ইতিহাস জানবেন এবং কিছু শারীরিক পরীক্ষা করতে পারেন। যদিও বিশেষভাবে Schizophrenia নির্ণয় করার কোন ল্যাবরেটরি পরীক্ষা নেই, ডাক্তার বিভিন্ন টেস্ট করবেন। ব্লাড টেস্ট এবং ব্রেইন ইমেজিং স্টাডি দ্বারা অন্য কোন কারণে উপসর্গগুলো হচ্ছে কিনা তা বোঝার চেষ্টা করবেন।
ডাক্তার যদি Schizophrenia এর উপসর্গ দেখা দেওয়ার অন্য কোন কারণ খুজে না পান, তাহলে তিনি রোগীকে একজন সাইকিয়াট্রিস্ট অথবা সাইকোলজিস্ট এর কাছে পাঠাবেন। সাইকিয়াট্রিস্ট এবং সাইকোলজিস্টরা বিশেষভাবে পরিকল্পিত সাক্ষাৎকার দ্বারা রোগীর মানসিক অবস্থা বোঝার চেষ্টা করে। যদি রোগীর কমপক্ষে ৬ মাস Schizophrenia এর উপসর্গ থাকে তাহলে তার Schizophrenia আছে বলে ধরা হয়।
কিভাবে সিজোফ্রেনিয়া এর চিকিৎসা করা হয়?
এই রোগ এর চিকিৎসার লক্ষ্য হচ্ছে উপসর্গ এবং নতুন সাইকোটিক এপিসোডের সম্ভাবনা কমানো। Schizophrenia এর চিকিৎসা হিসেবে নিচের পদক্ষেপগুলো নেয়া হতে পারেঃ
ঔষধঃ Schizophrenia এর চিকিৎসার জন্য antipsychotics নামক একটা ঔষধ সাধারণত ব্যবহার করা হয়। এটা Schizophrenia ভালো করে না। বরং এটা সবচেয়ে যন্ত্রণাপ্রদ উপসর্গগুলো যেমন delusions, hallucinations এবং চিন্তা করতে না পারা কমায়।
মানসিক চিকিৎসাঃ বিভিন্ন মানসিক চিকিৎসা দ্বারা সিজোফ্রেনিয়া এর বিভিন্ন উপসর্গকে ভালো করা যায়। এছাড়া মানসিক চিকিৎসার দ্বারা রোগীরা উপসর্গগুলোকে নিয়ন্ত্রনে রাখা শিখতে পারে।
হাসপাতালে ভর্তিঃ অনেক সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত রোগীর হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় না। তবে যারা নিজেদের অথবা অন্যদের ক্ষতি করতে পারে কিংবা বাড়িতে নিজেদের যত্ন নিতে না পারে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হতে পারে।
Electroconvulsive therapy (ECT): এই প্রক্রিয়ায় ঘুমানো অবস্থায় অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে রোগীয় মাথায় ইলেকট্রোড লাগানো হয় এবং কারেন্টের ছোট একটা শক দেওয়া হয়। এটা সাধারণত প্রতিসপ্তাহে ২-৩ বার করে কয়েক সপ্তাহ করা হয়। এটাতে রোগীর মানসিক অবস্থা এবং চিন্তার উন্নতি হয়।
সিজোফ্রেনিয়া তে আক্রান্ত রোগীরা কি বিপদজনক?
অনেক গল্পে এবং মুভিতে এই রোগ এ আক্রান্ত রোগীদের হিংস্র হিসেবে দেখানো হয়। এটা সাধারণত সত্যি না। অধিকাংশ রোগীরা হিংস্র না এবং তারা শুধুমাত্র একা থাকতে পছন্দ করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগীরা বিপদজনক কাজ করতে পারে। তবে এটা তারা সাধারণত ভয়ের কারণে করে থাকে।
সিজোফ্রেনিয়া কি প্রতিরোধ করা যায়?
এই রোগ প্রতিরোধ করার কোন উপায় ডাক্তারদের জানা নেই। তবে এটা যদি তাড়াতাড়ি ধরা পড়ে, তাহলে এটার মারাত্মকতা অনেকটা কমানো সম্ভব।
Discussion about this post