অধ্যাপক জুলফিকার রহমান খান
হেপাটোবিলিয়ারি ও প্যানক্রিয়েটিক সার্জন ,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
প্যানক্রিয়াস বা অগ্ন্যাশয়ের রোগগুলো বেশ জটিল ও মারাত্মক। এসব রোগে কিডনি, ফুসফুসসহ অনেক অঙ্গের ক্ষতি ছাড়াও রোগীর মৃত্যু হতে পারে।
প্যানক্রিয়াস দেহের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ, যাকে বলে অগ্ন্যাশয়। এর অবস্থান পেটের ভেতর পাকস্থলীর পেছনে, যার ওজন প্রায় ৮০ গ্রামের মতো। এটা হজমের জন্য অ্যানজাইম ও হরমোন নামের দুই ধরনের রস নিঃসরণ করে। অ্যানজাইম ক্ষুদ্র অন্ত্রে নিঃসরিত হয়, যা কার্বোহাইড্রেড, ফ্যাট ও প্রোটিন-জাতীয় খাদ্য হজমে সাহায্য করে। হরমোনের মধ্যে ইনসুলিন ও গ্লুকাগন রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
প্যানক্রিয়াসের প্রদাহ
প্যানক্রিয়াসের প্রদাহ দুইভাবে হতে পারে। অতিমাত্রায় প্রদাহ বা অ্যাকুইট প্যানক্রিয়াটাইটিস আর ধীরগতির প্রদাহ বা ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিস।
অ্যাকুইট প্যানক্রিয়াটাইটিস
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অ্যাকুইট প্যানক্রিয়াটাইটিসের প্রধান কারণ পিত্তনালির পাথর বা গলস্টোন। এ ছাড়া অতিরিক্ত মদ্যপান, রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা বৃদ্ধি, ডায়াবেটিস, অগ্ন্যাশয়ে আঘাত, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, অতিরিক্ত ওজন, সার্জারি, ইনফেকশন, জন্মগত ত্রুটি, আলসার বা জিনগত কারণেও অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ হতে পারে। তবে অনেক ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো কারণ থাকে না।
উপসর্গ : পেটের ওপরের দিকে তীব্র ব্যথা শুরু হয়ে পেছনের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। তীব্র ব্যথা থেকে বমিও হতে পারে। ব্যথার তীব্রতায় রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। এ সময় বমিসহ জ্বর ও হৃত্স্পন্দন বৃদ্ধি পেতে পারে।
রোগ নির্ণয় : রক্তে অ্যামাইলেজের মাত্রা, আল্ট্রাসাউন্ড, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সিটিস্ক্যান এবং ইআরসিপির মাধ্যমে রোগ নির্ণয় হয়।
চিকিৎসা : অ্যাকুইট প্যানক্রিয়াটাইটিসের বেশির ভাগ রোগীই সঠিক চিকিৎসায় সুস্থ হয়। প্রথমে তারা তীব্র ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। এ সময় রোগীকে মুখে খাবার বন্ধ করে স্যালাইন ও ব্যথার ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা শুরু করা হয়। জটিল রোগীদের আইসিইউতে ভর্তি করে পরিস্থিতি মনিটর করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্যানক্রিয়াসে অ্যাবসিস নেক্রোসিস, সিস্ট হতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে অপারেশন লাগে।
যদি পিত্তথলি ও পিত্তনালির পাথরের জন্য প্রদাহ হয়, তবে প্রদাহ কমার কমপক্ষে চার থেকে ছয় সপ্তাহ পর পিত্তথলির পাথরের অপারেশন করা ভালো। অপারেশনের পর প্যানক্রিয়াস বা অগ্ন্যাশয় স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ফিরে আসে।
ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিস
ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিস রোগীর ঘন ঘন পেটে ব্যথা হয়। খাদ্য হজম হয় না। ওজন কমে যায়। ফেনাযুক্ত পায়খানা হয়। ডায়াবেটিস হতে পারে।
রোগ নির্ণয় : রক্ত পরীক্ষা, আল্ট্রাসাউন্ড, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সিটিস্ক্যান ও ইআরসিপির মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করা হয়।
চিকিৎসা : অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মাধ্যমে চিকিৎসা করাতে হবে। যদি প্যানক্রিয়াটিক নালি বাধাগ্রস্ত হয়, তবে অবশ্যই অপারেশন করাতে হবে। চর্বিজাতীয় খাবার, যেমন—ডিম, দুধ, গরুর মাংস, খাসির মাংস, যেকোনো তৈলাক্ত খাদ্য কম খেতে হবে। খাদ্যে প্যানক্রিয়াটিক অ্যানজাইম যোগ করতে হবে।
প্যানক্রিয়াটিক টিউমার
প্যানক্রিয়াসের টিউমার বেশির ভাগই ক্যান্সার হয়। বেনাইন টিউমার খুবই কম। সে জন্য প্যানক্রিয়াসের টিউমার মানেই ক্যান্সার। মাঝবয়সী পুরুষ ও মহিলা সমান হারে এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। প্যানক্রিয়াসের মাথা ও শরীরে সাধারণত দুই ধরনের টিউমার হয়। বেশির ভাগ টিউমার মাথায় আক্রান্ত হয়। প্যানক্রিয়াসের মাথায় টিউমারের রোগী জন্ডিস, পেটে ব্যথা, পেটে চাকা নিয়ে আসে। বেশির ভাগ রোগীর ডায়াগনোসিস হয় অগ্রসর পর্যায়ে।
রোগ নির্ণয় : প্রাথমিক ইতিহাস, রক্ত পরীক্ষা, আল্ট্রাসাউন্ড, সিটিস্ক্যান, এমআরআই ও ইআরসিপির মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করা হয়।
চিকিৎসা : টিউমার যদি খুব প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়ে, তবে অপারেশন করালে রোগ সম্পূর্ণ উপশম হয়।
তবে দেখা গেছে, বেশির ভাগ রোগী অনেক দেরিতে বা শেষ অবস্থায় চিকিৎসকের কাছে যান। তখন সার্জারির ভূমিকা তেমন থাকে না। তবে এর অপারেশন খুব জটিল বিধায় অবশ্যই বিশেষজ্ঞ সার্জন দ্বারা করা উচিত। কিউরেটিভ অপারেশন করতে পারলে রোগী সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করেন। পেলিয়েটিভ অপারেশনে আরোগ্য লাভ সম্ভব নয়। তবে কিছু কিছু উপসর্গ যেমন—জন্ডিস, খাদ্যনালি অবস্ট্রাকশন থেকে সাময়িক নিরাময় হয়। এ ছাড়া ইআরসিপির মাধ্যমে স্ট্যান্টিং করালে সাময়িক উপশম হয়।
প্যানক্রিয়াস ও ডায়াবেটিস
প্যানক্রিয়াসের মধ্যে আইলেট সেল নামক কিছু কোষ থাকে। এ কোষগুলো ইনসুলিন নামক হরমোন নিঃসরণ করে। ইনসুলিন রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। এ কোষগুলো যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে ইনসুলিনের নিঃসরণ কম হবে। রোগীর ডায়াবেটিস হবে। ক্রনিক প্রদাহ বা সার্জারি করে প্যানক্রিয়াসের টিউমার অপসারণ করা হলে রোগী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারে।
প্যানক্রিয়াস ও জন্ডিস
পিত্তনালির নিম্নাংশ প্যানক্রিয়াসের মাথার মাঝ বরাবর প্রবাহিত হয়। যদি প্যানক্রিয়াসের মাথায় কোনো টিউমার হয়, তবে অতিরিক্ত চাপে পিত্তনালির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। তখন রোগীর জন্ডিস হয়। কোনো রোগীর জন্ডিস হলে অবশ্যই রক্ত পরীক্ষা ও আল্ট্রাসাউন্ড করে সঠিক রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা করাতে হবে। পিত্তনালির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলে যে জন্ডিস হয়, তা সার্জিক্যাল জন্ডিস।
প্যানক্রিয়াস পাথর
ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসে পাথর হতে পারে। এতে পেটে মাঝেমধ্যে তীব্র ব্যথা হয়। এ সময় খাদ্য হজম হয় না, ডায়াবেটিসও দেখা যায়।
চিকিৎসা : এসব ক্ষেত্রে অপারেশন করলে রোগী সুস্থ হয়ে যায়। রোগটি জটিল বিধায় বিশেষজ্ঞ সার্জন দ্বারা অপারেশন বা চিকিৎসা করা উচিত।
Discussion about this post