ব্যথার অভিজ্ঞতা হয় নাই এমন কেউ খুঁজে পাওয়া যাবে না। আবার তা যদি হয় কমরে ব্যথা তাহলে তো কথাই নাই। আমরা যেসকল ব্যথায় ভুগি তার মধ্যে কোমরে ব্যথা একটি অন্যতম কারণ। কারণ ভেদে সকল বয়েসের মানুষের মধ্যে কোমরে ব্যথা দেখা যায়। তবে মধ্যম ও অধিক বয়স্কদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। তাই আজ কোমরে ব্যথার আদ্যপান্ত নিয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করব।
কোমরব্যথার কারণ
যে কোনো ধরনের ব্যথার জন্য নিচের যে কোনো একটির ওপর অস্বাভাবিক চাপ বা ভেঙে যাওয়া বা ইনজুরিই প্রধান কারণ।
১. মাংসপেশি
২. হাড়
৩. জোড়া
৪. লিগামেন্ট
৫. জোড়ার আবরণ
৬. শিরদাড়া বা ভারটিব্রাল কলাম
৭. ডিস্ক (দুই কশেরুকার মধ্যে থাকে) ও
৮. স্নায়ুর রোগ বা ইনজুরি।
তাই কোমরে ব্যথাও এর ব্যতিক্রম নয়। আসুন জেনে নেয়া যাক কী কী কারণে এসব উপসর্গ তৈরি হতে পারে।
বুক, পেট ও তলপেটের মধ্যকার বিভিন্ন অঙ্গের সমস্যার জন্য কোমরব্যথা হতে পারে।
১. যারা অফিসে দীর্ঘক্ষণ বসে একই ভঙ্গিতে কাজ করেন। এতে দেখা যায়, কোমরের মাংস পেশি, কোমরের বিভিন্ন জোরা বা জয়েন্টস ও স্নায়ুতে চাপ তৈরি হয়। এরকম কিছুদিন চলতে থাকলে সেটা ব্যথায় রূপ নেয় ও পরবর্তীতে ব্যথা প্রচণ্ড হয়ে থাকে।
২. বসার চেয়ার টেবিল ঠিকমতো না হলে বা ঠিকমতো না বসলে বা সামনে-পেছনে ঝুঁকে বসলে একই কারণে কোনো সময় কোমরে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
৩. দীর্ঘক্ষণ ড্রাইভিং করলে বা বেশি সামনে ঝুঁকে গাড়ি চালালে কোমর ব্যথা হতে পারে।
৪. যারা শুয়ে বা কাত হয়ে বই পড়েন বা সোফায় শুয়ে টিভি দেখেন বা অন্য কাজ করেন, তাদের মেরুদণ্ড বা ভারটিব্রাল কলাম দীর্ঘ সময় তার স্বাভাবিক অবস্থান থেকে ব্যতিক্রম অবস্থানে থাকেন। যে কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ব্যথা অনুভূত হয়।
৫. অনেকেই আছেন যারা কোনো ভারী জিনিস সঠিক নিয়মে তোলেন না। ফলে মেরুদণ্ডে অস্বাভাবিক চাপ পড়ে এবং তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ব্যথা হয়।
৬. অস্বাভাবিক পজিশনে ঘুমানোর কারণে অনেকেই ব্যথায় আক্রান্ত হতে পারেন।
৭. আঘাত জনিত কারণে উপরে উল্লেখিত যে কোনো একটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ব্যথা হতে পারে।
৮. যারা বয়োবৃদ্ধ আছেন তাদের দীর্ঘদিন ধরে শরীর নাড়াচাড়া বা জয়েন্টস একই অবস্থায় থাকতে থাকতে মাংশপেশী শিকিয়ে যায়, জয়েন্টসগুলো শক্ত হয়ে স্নায়ুর উপর চাপ বৃদ্ধি করে ফলে ব্যথা হয়।
৯. এছাড়াও অস্টিওপোরোসিস বা হাড় ক্ষয় রোগ। যাতে আমাদের শরীরের হাড়গুলো ক্যালসিয়াম ধরে রাখতে পারে না। যে কারণে হাড়গুলো নরম ও ভঙ্গুর হয়। আবার এতে আমাদের দুই কশেরুকার মাঝে যে নরম জেলির মতো পদার্থ থাকে বা ইন্টারভারটিব্রাল ডিস্ক থাকে তার উপর চাপ পড়ে। সেটা আবার আমাদের শরীরের দুই পাশের ব্যথা নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ুর ওপর চাপ বাড়ায় এবং কোমরে ব্যথা হতে পারে।
কাদের বেশি হয়?
১. কোমরে ব্যথা সাধারণত বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে। বেশি দেখা যায় ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সের পর থেকে।
২. কায়িক শ্রমের অভাব বা নিয়মিত ব্যায়ামের অভাবে পেট ও পিঠের মাংসপেশি চাপ ধরে যায়। ফলে একটু পরিশ্রমেই ব্যথা হতে পারে।
৩. অতিরিক্ত ওজনের কারণে কোমরের মাংসপেশি এবং হাড়ের ওপর চাপ পড়ে। ফলে ব্যথা হতে পারে।
৪. অনেক সময় কিডনিতে পাথর হলে বা প্রস্রাবে ইনফেকশন হলেও কোমরে ব্যথা হতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে শুধু কোমরে ব্যথাই না, অন্য আরো অনেক উপসর্গও থাকবে। তাই কোমরে ব্যথা হলেই সেটা কিডনি স্টোন বা ইউরিন ইনফেকশন নয়।
৫. ডিপ্রেশন বা স্ট্রেমের কারণেও কোমরে ব্যথা হতে পারে।
৬. মদ্যপান এবং স্মোকিং-এর কারণেও কোমরে ব্যথা হয়। স্মোকিং-এর কারণে রক্তনালী চিকন হয়ে যায় এবং কোমর থেকে নিচের দিকে ঠিকমত রক্ত প্রবাহ হয় না। যার ফলে হাড় ঠিকমত পুষ্টি পায় না এবং দুর্বল হয়ে পড়ে।
৭ অস্টিও পোরোসিসের কারণে অনেক মাঝ বয়েসী নারীদের মাজায় ব্যথা হতে পারে।
কখন সতর্ক হবেন?
কোমরে ব্যথার পাশাপাশি কিছু কিছু সিম্পটমস আছে যা অনেক রোগের অ্যালার্মিং সাইন। যেমন-
• যদি কোমরে ব্যথার সঙ্গে সঙ্গে প্রস্রাব বা পায়খানার কোনো পরিবর্তন খেয়াল করেন।
• যদি সঙ্গে জ্বর থাকে।
• আঘাত পেলে বা কোনো প্রকার ট্রমা হলে।
• যদি ব্যথার তীব্রতা প্রচণ্ড আকার ধারণ করে এবং রেস্ট নিলেও না কমে।
• যদি ব্যথা এক বা দুই পায়েই নেমে যায়, বিশেষ করে হাঁটুর নিচে।
• যদি ব্যথার সঙ্গে সঙ্গে দুর্বলতা, অবশভাব বা পায়ে ঝিম ঝিম অনুভুতি হয়।
• যদি ব্যথার সঙ্গে সঙ্গে ওজন কমতে থাকে।
• যে কোনো প্রকার স্টেরয়েড ওষুধ খাওয়ার পর যদি ব্যথা শুরু হয়।
• যদি আপনার অতিরিক্ত মদ পান বা সিগারেটের বদভ্যাস থাকে।
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন?
সব সময় ধরে বা জমে আছে—এ ধরনের ব্যথা।
ভারী ওজন তোলা বা অতিরিক্ত কাজের পর তীক্ষ্ণ ব্যথা।
কোমর থেকে নিতম্ব, ঊরু ও পায়ের আঙুল পর্যন্ত ব্যথা বিস্তৃত হলে।
পায়ে দুর্বলতা বা অবশ ভাব হলে।
হাঁচি, কাশি দিলে বা সামনে ঝুঁকলে ব্যথা বেড়ে যায়।
প্রস্রাব বা পায়খানার নিয়ন্ত্রণ না থাকলে।
শোয়া অবস্থায় বা শোয়া থেকে ওঠার সময় ব্যথা হলে।
লেখক: কনসালটেন্ট ও পেইন ফিজিশিয়ান, কুরমিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা।
Discussion about this post