ডায়াবেটিস রোগটি আজীবনের রোগ। এটি কখনোই সম্পূর্ণরূপে সেড়ে যায় না। তবে সচেতন হলে এবং সুচিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে এ রোগকে খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকলে অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি যেমন কমে যাওয়ার পাশাপাশি স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপন করতে পারার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
ডায়াবেটিস রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতি সমূহ:
কোন ব্যক্তির টাইপ-১ অথবা টাইপ-২ আছে কিনা তা নির্ণয় করার জন্য বেশ কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে এবং গর্ভকালীন ডায়বেটিস শনাক্তকরণে একটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।
ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট (OGTT):
ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট ডায়বেটিস নির্ণয় করার জন্য বিশ্ব স্বীকৃত পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে রোগী খালি পেটে থাকাকালীন রক্তে শর্করার পরিমাণ পরিমাপ করা হয়। তারপরে রোগীকে একটি চিনিযুক্ত তরল পান করতে দেওয়া হয় এবং রক্তের শর্করার মাত্রা দুই ঘন্টা পর আবার পরীক্ষা করা হয়। খালি পেটে রক্তের শর্করার মাত্রা ৫.৬ মিলি মোলের বেশি (less than 5.6 mili mol) এবং দুই ঘন্টা পরে ৭.৮ মিলি মোলের কম (less than 7.8 mili mol) ডায়াবেটিস নেই বলে ধরা হয়।
রেন্ডম ব্লাড সুগার (RBS):
রেন্ডম ব্লাড সুগার (RBS) পরীক্ষা করে গ্লুকোজের মাত্রা ১১.১ মিলিমোল/লিটার (mmol/l) অথবা তার বেশি পাওয়া গেলে ধারণা করা হয় তার ডায়াবেটিস আছে। যদি গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিক অর্থাৎ ৫- ১১.১ মিলিমোল/লিটার (mmol/l) এর মধ্যে থাকে, পুরোপুরি নিশ্চিত হবার জন্য OGTT পরীক্ষা করতে হবে।
ফাস্টিং ব্লাড সুগার (FBS):
ফাস্টিং ব্লাড সুগার (FBS) পরীক্ষা RBS এর চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর। কারো রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা সকালে খালি পেটে ৭.০ মিলিমোল/লিটার বা তার বেশি হলে নিশ্চিত ভাবে বলা যায় ডায়াবেটিস হয়েছে এবং যদি ৬.১-৬.৯ মিলিমোল/লিটার ভিতরে থাকে তাহলে বুঝতে হবে ব্যক্তির ডায়াবেটিস হয়নি কিন্তু হওয়ার পথে রয়েছে।
গ্লাইকেটেড হিমোগ্লোবিন এ১ সি (HbA1c):
এটি একটি রক্ত পরীক্ষা, যার জন্য খালি পেটের প্রয়োজন হয় না। এই পরীক্ষা গত ২-৩ মাস ধরে আপনার রক্তে গড় শর্করার মাত্রা নির্দেশ করে। এটি নির্দেশ করে রক্তের শতকরা কত ভাগ শর্করা হিমোগ্লোবিনের সাথে সংযুক্ত হয়। আপনার রক্তে শর্করার মাত্রা যত বেশি হবে আপনার শর্করাও তত বেশি হিমোগ্লোবিন এর সাথে লাগবে। দুটি পৃথক পরীক্ষায় যদি হিমোগ্লোবিন এ১ সি এর মাত্রা ৬.৫ শতাংশ বা তারও বেশি হয় তবে আপনার ডায়াবেটিস রয়েছে। ৫.৭ থেকে ৬.৪ শতাংশের মধ্যে থাকলে তা প্রি-ডায়বেটিস নির্দেশ করে। ৫.৭ শতাংশের নিচে থাকলে তার ডায়াবেটিস নেই বলে বিবেচিত হয়।
গর্ভকালীন ডায়বেটিস শনাক্তকরণ:
গর্ভকালীন মায়েদের ডায়াবেটিস আছে কিনা তা জানার জন্য জিসিটি (GCT) নামে একটি পরীক্ষা পদ্ধতি আছে। এই পদ্ধতিতে দিনের যেকোন সময়ে (খালি বা ভরা পেট যেকোন ভাবে) গর্ভকালীন সময়ে মা’কে ৫০ গ্রাম গ্লুকোজের শরবত খাওয়ানোর ১ ঘণ্টা পরে রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। গ্লুকোজের মাত্রা ৭.৮ মিলিমোল/লিটার বা তার চেয়ে বেশি হলে তাকে জিসিটি পজিটিভ হিসেবে ধরে নিতে হবে। GCT পজিটিভ হলে অবশ্যই ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স পরীক্ষা করতে হবে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে যেসব রোগ হতে পারে:
ডায়াবেটিসকে অন্যান্য রোগের সূতিগাকার বলা হয় কারণ দীর্ঘসময় ধরে
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, কিডনীর কার্যক্ষমতা লোপ পাওয়া, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, পায়ে পচনশীল ক্ষত, চক্ষুরোগ, পক্ষাঘাত, স্নায়ুতন্ত্রের জটিলতা, মুত্রাশয়ের রোগ, প্রস্রাবে আমিষ বের হওয়া, যক্ষা, মাড়ির প্রদাহ, পাতলা পায়খানা, চুলকানি, ফোঁড়া, যৌন ক্ষমতা কমে যাওয়া ইত্যাদি এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে অকালে সন্তান প্রসব, জন্মের পর পরই শিশুর মৃত্যু, বেশি ওজনের শিশু হওয়া, মৃত শিশুর জন্ম, অটিজম ইত্যাদি নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে করণীয়:
• ডায়াবেটিস হলে চিকিৎসকের পরামর্শনুযায়ী খাদ্যের একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলা ও খাদ্য গ্রহণে নিয়ন্ত্রণ আনা সবচেয়ে জরুরি। শরীরে খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা ডায়াবেটিস হওয়ার আগে ও পরে একই রকম থাকে। তাই, খাদ্যের নিয়ম মেনে চলার মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি স্বাস্থ্যও ভাল রাখা যায়। ডায়াবেটিস আজীবনের রোগ, তাই সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণে এই রোগকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
• ডায়াবেটিক রোগীদের অবশ্যই নিয়মিত হাঁটা, ব্যায়াম করা এবং শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম করলে শরীর সু্স্থ থাকার পাশাপাশি ইনসুলিনের কার্যকারিতা ও নি:সরণের পরিমাণ বেড়ে যায়। প্রতিদিন কমপক্ষে ৪৫ মিনিট হাঁটলে শরীর যথেষ্ট সু্স্থ থাকবে। শারীরিক অসুবিধা থাকলে, যতটুকু সম্ভব কায়িক পরিশ্রম করতে হবে। বিশেষ করে বয়স্ক রোগীদের ক্ষেত্রে এগুলো যথাযথভাবে পালন করতে পারলে রোগ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
• টাইপ-১ ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে ইনসুলিন ইনজেকশনের প্রয়োজন হতে পারে। টাইপ-২ ডায়াবেটিক রোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসক শর্করা কমাবার জন্য খাবার বড়ি দিতে পারেন।
• চিনি ও মিষ্টি জাতীয় খাবার পরিমিত খাওয়া।
• চাল, আটা এবং মিষ্টি ফল ইত্যাদি হিসেব করে খাওয়া।
• ডাল, শাক, সবজি, টক জাতীয় ফল ইত্যাদি আঁশবহুল খাবার বেশি খাওয়া।
• উদ্ভিজ্জ তেল অর্থাৎ সয়াবিন, সরিষার তেল ইত্যাদি এবং সব ধরনের মাছ খাওয়ার অভ্যাস করা।
• ওজন স্বাভাবিক রাখা।
• মাংস, চর্বি, ঘি, মাখন, ডালডা ইত্যাদি ফ্যাট জাতীয় খাবার যতটা সম্ভব কম খাওয়া।
• অন্য কোনও রোগে আক্রান্ত হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাদ্যব্যবস্থা গ্রহণ করা।
• ধূমপান বন্ধ করতে হবে।
• নিয়মিত প্রস্রাব (Urine) পরীক্ষা করতে হবে
• ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসা বন্ধ রাখা যাবে না।
• শারীরিক কোন অসুবিধা দেখা দিলে দেরী না করে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
ডায়াবেটিসের চিকিৎসা:
রক্তে শকর্রার স্বল্পতা বা হাইপোগ্লাইসেমিয়া হলে রক্তে শর্করার পরিমাণ কমানোর জন্য ট্যাবলেট অথবা ইনসুলিন দেয়া হয়। ট্যাবলেট খাওয়ার বা ইনসুলিন নেয়ার ফলে যদি শর্করার পরিমাণ খুব কমে যায় তাহলে শরীরে কিছু প্রতিক্রিয়া, যেমন- অসু্স্থ বোধ করা, বুক ধড়ফড় করা, শরীর কাঁপতে থাকা, বেশি ঘাম হওয়া, শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, অস্বাভাবিক আচরণ করা, খুব বেশি খিদে পাওয়া ইত্যাদি হতে পারে।
ট্যাবলেট বা ইনসুলিন গ্রহণের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় বেশি হলে, ইনসুলিন ও সিরিঞ্জ একই মাপের না হলে, খুব কম খেলে বা খাবার না খেলে, ইনসুলিন গ্রহণের পরে খুব দেরী করে খাবার খেলে এ সমস্যাগুলো হতে পারে। রক্তে শকর্রার অভাব হলে রোগীকে চা-চামচের ৪ থেকে ৮ চামচ গ্লুকোজ বা চিনি এক গ্লাস পানিতে গুলে খাইয়ে দিতে হবে অথবা গ্লুকোজ ইনজেকশন দিতে হবে এবং দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
আবার, অপর্যাপ্ত ইনসুলিন নিলে অথবা ইনসুলিন নির্ভর রোগী ইনসুলিন একেবারেই না নিলে রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে গিয়ে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। শরীরে ইনসুলিনের অভাব হলে, ইনসুলিনের অভাবে রক্তের শর্করা শরীরের কোন কাজে লাগতে পারে না, তখন তাপ ও শক্তির জন্য দেহে সঞ্চিত চর্বি ব্যবহার হতে থাকে। কিন্তু পর্যাপ্ত ইনসুলিনের অভাবে এই চর্বি অধিক হারে ভাঙ্গার ফলে রক্তে কিছু ক্ষতিকর পদার্থ ও অম্ল বেড়ে যায়, ফলে এসিটোন (Acetone) নামক একটি কিটোন (ketone) বডিতে অধিক পরিমাণে বেড়ে গেলে, অম্লতার জন্য রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়। এই অবস্থাকে বলে ডায়াবেটিক কোমা (diabetic coma)।
প্রস্রাবে শর্করার পরিমাণ খুব বেশি বেড়ে গেলে, খুব বেশি বা ঘন ঘন পিপাসা লাগলে, ঘন ঘন প্রস্রাব হলে, বেশি বেশি ক্ষুধা লাগলে, খুব অসু্স্থ বোধ হলে, বমি বমি ভাব হলে, শরীরে দুর্বলতা অনুভূত হলে, ঝিমানো ভাব, শ্বাস কষ্ট হলে, নিঃশ্বাস দ্রুত হলে, প্রচণ্ড মাথা ধরলে, নিস্তেজ অনুভূত হলে ইত্যাদি ডায়াবেটিক কোমার লক্ষণ। এই লক্ষণ গুলি দেখা দিলে শরীরে পানি স্বল্পতা কমানোর জন্য অতিরিক্ত লবণ মিশ্রিত পানি খেতে হবে, ইনসুলিনের পরিমাণ বাড়াতে হবে এবং প্রস্রাবে কিটোন বডি আছে কিনা তা পরীক্ষা করতে হবে এবং দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
Discussion about this post