এন এস এম মোজাম্মেল হক
বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে মা ও শিশুস্বাস্থ্যের। মাতৃমৃত্যুহার প্রতি লাখ জীবিত জন্মে সরকারি হিসাবে ১৭২ জন। নবজাতকের মৃত্যুহার প্রতি হাজারে ১৬ জন এবং শিশুমৃত্যুহার (অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর) প্রতি হাজারে ৩০ জন। চার বছর বয়সী শিশুর ক্ষেত্রে এই হার ৮৪ শতাংশ (সূত্র: বাংলাদেশ পরিসংখান ব্যুরো, ২০১৮)। স্বাস্থ্য খাতে অগ্রগতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কলেরা, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, পোলিও, হাম, ডিফথেরিয়া, হুপিং কাশি প্রায় নির্মূল করা। শতভাগ কালাজ্বর নির্মূলের লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে ২০১৫ সালে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। ২০১৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশকে পোলিও মুক্ত দেশের সনদ দিয়েছে।
বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সূচকে (‡lobal Health Index) ১১৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৮তম। পাশের দেশ ভারতের অবস্থান ৯৪তম ও পাকিস্তান ১০২তম। বিগত দুই দশকে বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক খাতে যে অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে তা বর্তমান সরকারে গৃহীত জনকল্যাণমূলক পরিকল্পনা ও কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের প্রতিফলন। আমাদের লক্ষ্য ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলা, যেখানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা হবে।
রক্তস্বল্পতা বাংলাদেশের শিশুদের স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে অন্যতম একটি। বিষয়টি সচেতনতার অভাবে আক্রান্ত শিশুর অভিভাবকরা নজরে নেন না। অন্যান্য রোগ যখন প্রকাশ পায়, তখন সেদিকেই দৃষ্টি দেওয়া হয়। একজন সুস্থ মানুষের দেহে গড়ে চার দশমিক পাঁচ থেকে পাঁচ দশমিক পাঁচ লিটার রক্ত থাকে। রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ সর্বনি¤œ ১০ শতাংশ পর্যন্ত স্বাভাবিক। শরীরে রক্তের পরিমাণ কিংবা রক্তে লোহিত রক্তকণিকার পরিমাণ কিংবা রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যাওয়ার অপর নাম অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা। লোহিত রক্ত কণিকা শরীরে অক্সিজেন বহন করে। রক্তে অক্সিজেন কমে গেলে ছোট-বড় সব মানুষই অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে, শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হয়।
রক্তস্বল্পতার কারণে বুদ্ধি বৃদ্ধির কার্যক্রম ব্যাহত হয়, রোগ আক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে। শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং মানসিক বিকাশ বাধা পায়। সর্বোপরি দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি হয়। এই রক্তস্বল্পতা বাংলাদেশের শিশুদের জন্য একটি বড় স্বাস্থ্য সমস্যা। পরিসংখ্যানে জানা গেছে, পাঁচ বছরের নিচের প্রায় ৪৬ শতাংশ শিশু এ রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৪৩ শতাংশ কিশোর-কিশোরী, ৪৫ শতাংশ নারী (গর্ভবতী নন) এবং ৪৯ শতাংশ গর্ভবতী নারী রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। উল্লেখ্য, অতিরিক্ত রক্তস্বল্পতায় ভোগা মানুষের সংখ্যা এক থেকে তিন শতাংশ। বাংলাদেশে ছয় থেকে ৫৯ মাস বয়সী শিশুদের মধ্যে রক্তস্বল্পতা পরীলক্ষিত হয়েছে বেশি মাত্রায়।
বিভিন্ন কারণে শিশুদের রক্তস্বল্পতা দেখা দিতে পারে। লৌহ উপাদানের (ওৎড়হ) ঘাটতি একটি অন্যতম কারণ। গর্ভবতী মায়ের রক্তস্ব^ল্পতা এবং পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ না করার কারণে শিশু মাতৃগর্ভ থেকে লৌহ ঘাটতি নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে থাকে। কাজেই দেখা যাচ্ছে শিশুদের রক্তস্বল্পতার বিষয়টি এককভাবে শিশুর নয়। এজন্য শিশুর মাও দায়ী সমানভাবে। অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সময় মাতৃগর্ভ থেকে শিশুর কৈশোর পর্যন্ত ব্যাপৃত। মা যখন শিশু থাকে তখন থেকেই রক্তস্বল্পতার বিষয়টি লক্ষণীয়। মেয়েদের ঋতুস্রাব, খাদ্যমান সম্পর্কে সঠিক তথ্য না জানা, সঠিক সময়ে খাদ্য গ্রহণ না করা এবং পর্যাপ্ত লৌহ সমৃদ্ধ খাবার না খাওয়ার কারণে তাদের শরীরে লৌহের ঘাটতি থাকে। এ পর্যায়ে যখন গর্ভধারণ করে তখন সন্তান মায়ের শরীর থেকে যেটুকু লৌহ সমৃদ্ধ খাবার পাওয়ার কথা তা পায় না। এ অবস্থায় যদি মা পর্যাপ্ত পরিমাণ লাল মাংস, মাছসহ বিভিন্ন প্রোটিন, দুধ, শাকসবজি এবং ভিটামিন ও ফলিক এসিড না খায় তাহলে সন্তানের ও মায়ের লাল রক্তকণিকার সংখ্যা বৃদ্ধি পায় না। আবার এ সময় অনেক মা পেটে গ্যাস থাকার কারণে ক্যালসিয়াম খান না। ক্যালসিয়াম এবং লৌহ উপাদানের মধ্যে একটি সাংঘর্ষিক অবস্থা থাকে, যা লাল রক্তকণিকা গঠনের অন্তরায়। ফলে মায়ের শরীরে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়।
কারও কারও শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা এমনিতেই কম থাকতে পারে। শিশুর জন্মের পর তিন মাস বয়স পর্যন্ত শিশুর শরীরে যেটুকু লাল রক্তকণিকা থাকে, তা সে তার মায়ের কাছ থেকেই নিয়ে থাকে। এরপর তার নিজের শরীরের অস্থিমজ্জায় তা তৈরি হতে শুরু করে। এই রক্ত তৈরির কাঁচামাল হলো আয়রণ বা লৌহ। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর চাহিদা বাড়তে থাকে বলে শিশুকে আয়রণ সমৃদ্ধ খাবার দিতে হবে। তা না হলে শিশুর রক্তশূন্যতা দেখা দেবে। ছয় মাস বয়স থেকে শিশুকে বুকের দুধের পাশাপাশি অল্প অল্প করে পরিপূরক খাবার খাওয়াতে হবে। প্রাণিজ ও উদ্ভিজ্জ খাদ্য উৎস থেকে লৌহ সমৃদ্ধ উপাদান পাওয়া যায়। অর্থাৎ প্রাণিজ এবং উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে খাদ্য নিয়ে সুষম খাবার দিতে হবে প্রতিটি মা ও শিশুকে।
শিশুকে মাছ, মাংস, শাকসবজি ও ফলমূল খাবারে অভ্যস্ত করতে হবে। খাবারে যথেষ্ট পরিমাণে ভিটামিন ‘সি’ ফলিক এসিড, ভিটামিন বি১২ রাখতে হবে। দুই বছর থেকে শিশুকে কৃমির ওষুধ, (উবড়িৎসরহম গবফরপরহব) খাওয়াতে হবে এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
শিশুর রক্তস্বল্পতা দূরীকরণে গরুর লাল মাংস, কলিজা, মুরগির কলিজা, ডিম, সামুদ্রিক মাছ প্রভৃতি খাওয়াতে হবে। আয়রন শোষণে ভিটামিন ‘সি’র বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। ভিটামিনের অভাবে লাল রক্তকণিকা কমে যেতে পারে। লেবু, কমলা, আমলকী, জলপাই, আঙুর, জাম্বুরা, পেয়ারা, আমড়া প্রভৃতি ফলে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন ‘সি থাকে, যা শিশুদের রক্ত বৃদ্ধিতে সহায়ক। ভিটামিন ‘বি৯ বা ফোলেট মানবদেহ প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়। লাল রক্তকণিকা তৈরিতে ফলিক এসিডের গুরুত্ব অনেক।
সবুজ পাতাযুক্ত শাকসবজি, কাঁচাকলা, ব্রুকলি, শিমের বিচি, ডুমুর, কলার মোচা, মুগডাল ইত্যাদিতে প্রচুর আয়রণ আছে। বিট, আপেল, কলা, বেদানা প্রভৃতি ফল রক্তে আয়রন বা লৌহ উপাদান বাড়াতে খুবই উপকারী। মিষ্টি আলুতে পটাশিয়াম ও ফলিক এসিড রয়েছে প্রচুর। কিশমিশ, খেজুর, অ্যাপ্রিকট, আলুবোখারা ও বাদামে যথেষ্ট খনিজ লবণ ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান রয়েছে। দুধের সঙ্গে মিশিয়ে এসব খাবার শিশুদের খাওয়ানো যায়।
একটি বিষয় স্পষ্ট, লৌহ উপাদান বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এর ঘাটতি মেটাতে কোন কোন খাবার গ্রহণ করতে হবে, সে সম্পর্কে সচেতনতা। এ সচেতনতা মায়ের জন্য অতীব প্রয়োজন, কারণ মায়ের নিজের যেমন এসব খাদ্য গ্রহণ করতে হবে, তেমনি শিশু জন্মের পর শিশুকেও আয়রণ সমৃদ্ধ খাবার খাওয়াতে হবে। আয়রন সমৃদ্ধ খাবারগুলো দুষ্পাপ্য নয় বরং সহজলভ্য। শুধু প্রয়োজন জ্ঞান ও সচেতনতা।
আমরা একটি উন্নত সমাজ, সমৃদ্ধ দেশ গড়তে যাচ্ছি। স্বাস্থ্যবান জাতি ছাড়া দেশ উন্নত হতে পারে না। স্বাস্থ্য সচেতনতা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বুদ্ধিমান, বলিষ্ঠ ও কর্মক্ষম করে গড়ে তুলবে। রক্তস্বল্পতার হাত থেকে শিশুদের বাঁচাতে মা এবং পরিবারকে এগিয়ে আসতে হবে। শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ আমাদের ভবিষ্যতে উজ্জ্বল করবে।
পিআইডি নিবন্ধ
Discussion about this post