লিভার ক্যান্সার বা হেপাটিক ক্যান্সার হল সেই ধরণের ক্যান্সার, যা শরীরের অন্য কোন অঙ্গ বা অংশ থেকে লিভারে ছড়ায় না বরং লিভারেই প্রথমে হয়। লিভারের ক্যান্সার অন্য জায়গা থেকে ছড়ালে তাকে মেটাস্টেসিস বলে। লিভারে শুরু হওয়া ক্যান্সারের তুলনায় এটা অনেক বেশী প্রচলিত। সবথেকে প্রচলিত ক্যান্সারের ধরন হল হেপাটোসেলুলার কার্সিনোমা এবং এটা মেয়েদের থেকে ছেলেদের বেশী হয়।
লিভার ধারাবাহিক ভাবে রক্তকে ছেঁকে সারা শরীরে সংবাহিত করে এবং পরিপাকতন্ত্র থেকে ওষুধ এবং পুষ্টি উপাদানকে শোষণ করে সহজেই ব্যবহারযোগ্য রাসায়নিকে রূপান্তরিত করে। সারা শরীরের সব রক্তকে যেহেতু লিভারের মধ্যে দিয়ে বাহিত হতে হয়, তাই সাধারণ ভাবে ক্যান্সার কোষ সহজে রক্তস্রোতে মিশতে পারে না।
লিভার ক্যান্সারের অধিকাংশই সেকেন্ডারি কিংবা মেটাস্টেটিক, অর্থাৎ যা শরীরের অন্য কোথাও শুরু হয়েছে। লিভার অসংখ্য বিভিন্ন ধরণের কোষ দিয়ে তৈরি হয়, সুতরাং এখানে বিভিন্ন ধরণের টিউমার হতে পারে। তার মধ্যে কিছু বিনাইন (ননক্যান্সারাস) এবং কিছু ক্যান্সারাস, যা শরীরের অন্য অঙ্গে ছড়াতে পারে (মেটাস্টেসাইজ)।
লক্ষণ
প্রাইমারি লিভার ক্যান্সারের প্রথমদিকে অনেকের ক্ষেত্রেই কোন ধরণের লক্ষণ দেখা যায় না। লক্ষণ যখন দেখা যায় তখন তা হলঃ
- তলপেটে ব্যথা, অনেক সময়ে ব্যথা ডানদিকে হয় এবং সেই ব্যথা কখনও কাঁধ পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়
- জন্ডিসের ক্ষেত্রে ত্বক, জিভ এবং চোখের সাদা অংশ হলুদ হয়ে যায়
- বিনা কারণে ওজন কমে যায় এবং অবসাদ
- হেপাটোমেগালি, যেখানে লিভার আকারে বড় হয়ে যায় এবং পেট ফুলে যায়
- গা গোলানো এবং এমেসিস (বমি)
- পিঠে ব্যথা এবং জ্বর
- সাধারণ চুলকানি
কারণ
লিভারের কোষের ডিএনএ-তে কোন বদল বা পরিব্যাক্তি বা পরিবর্তন হলে লিভার ক্যান্সার হয়। এটা শরীরের প্রতিটি রাসায়নিক প্রক্রিয়ার নির্দেশ পাঠায় এবং যার পরিব্যাক্তি বা পরিবর্তন হলে তার নির্দেশ বদলে যায়। ফলস্বরূপ, কোষ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে এবং ঘটনাক্রমে টিউমার তৈরি হতে পারে, যা হল ক্যান্সারাস কোষ সমূহের সমষ্টি।
লিভার ক্যান্সারের অন্যান্য ঝুঁকি হলঃ
১. মেদবহুলতা- এটা হেপাটোসেলুলার কারসিনোমার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
২. লিঙ্গ- মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের ক্ষেত্রে হেপাটোসেলুলার কারসিনোমা হবার সম্ভবনা বেশী হয়।
৩. অ্যানাবলিক স্টেরয়েডের ব্যবহার- ক্রীড়াবিদদের ক্ষেত্রে, পেশীর শক্তি বাড়াবার জন্য পুরুষ হরমোনের অপব্যবহার অনেকদিন ধরে যদি হয় তাহলে সেটা লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি সামান্য হলেও বাড়িয়ে দেয়।
৪. জাতি- আমেরিকা, প্যাসিফিক দ্বীপপুঞ্জ এবং এশিয় আমেরিকানদের ক্ষেত্রে হামেশাই লিভার ক্যান্সার হয়।
৫. হজম সংক্রান্ত জিনগত রোগ- শরীরের স্বাভাবিক মেটাবোলিজমের ক্ষতি করে যে সব রোগ সেটা লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
৬. ডায়াবেটিসের ইতিহাস- গবেষণা ডায়াবেটিস এবং ক্যান্সারের যোগসূত্র দেখিয়ে দিয়েছে। ফ্যাটি লিভারের রোগের সাথে ডায়াবেটিসের সুত্রের জন্যে এটা হয়।
৭. বিরল রোগ- গবেষণায়, আলফা-১-অ্যাট্রিরাইস্পিনের অভাব, থাইরোসিনেমিয়া এবং উইলসন রোগের মতন বিরল রোগের সাথে লিভার ক্যান্সারের যোগসূত্র প্রমাণিত হয়েছে।
৮. অ্যাফ্লাটক্সিন- এটা ফাঙ্গাস দিয়ে তৈরি একটা পদার্থ, যা বাসি বা ছাতা পড়া গম, ভুট্টা, বাদাম, সয়াবিন এবং চীনাবাদামে পাওয়া যায়। এগুলোর সাথে দীর্ঘদিনের সংস্পর্শ লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
৯. জিনগত লিভারের রোগ এবং লিভারের রোগ- হেপাটাইটিস বি বা সি রোগে আক্রান্তদের লিভার ক্যান্সার হবার ঝুঁকি বেশী থাকে।
১০. সিরোসিস- লিভার কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে স্কার টিস্যু দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। লিভার সিরোসিসের রুগীদের লিভার ক্যান্সার হবার ঝুঁকি বেশী।
রোগ নির্নয়
লিভার ক্যান্সার ডায়াগনিসিসের টেস্ট এবং পদ্ধতি হলঃ
ইমেজিং স্ক্যানঃ হয় এমআরআই অথবা সিটি স্ক্যান।
রক্ত পরীক্ষাঃ এএফপি (আলফা ফেটোপ্রোটিন) এক ধরণের প্রোটিন, যা লিভার টিউমার দ্বারা তৈরি হয় এবং রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে বোঝা যায়।
বায়োপসিঃ টিউমার টিস্যুর সামান্য নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষা দেখায় যে টিউমার ক্যান্সারাস (ম্যালিগন্যান্ট) না কি ননক্যান্সারাস (বিনাইন)।
ধাপ
লিভার ক্যান্সার চারটে ধাপে ভাগ করা হয়ঃ
প্রথম ধাপ বা স্টেজ ওয়ানঃ এখানে, টিউমার কেবল লিভারের ভেতরে/ওপরে এবং অন্য কোথাও হয়।
দ্বিতীয় ধাপ বা স্টেজ টুঃ হয় লিভারের মধ্যে অসংখ্য ছোট টিউমার কিংবা একটা বড় টিউমার হয় যা রক্তনালী পর্যন্ত পৌঁছেছে।
তৃতীয় ধাপ বা স্টেজ থ্রিঃ অনেকগুলো বড় অথবা শুধুই একটা বড় টিউমার যা মুখ্য রক্তবাহী নালী পর্যন্ত পৌঁছেছে। এই ধাপে ক্যান্সার পিত্তকোষ অবধিও যেতে পারে।
চতুর্থ ধাপ বা স্টেজ ফোরঃ মেটাস্টেসিস, লিভার ক্যান্সার যা শরীরের অন্যান্য অঙ্গেও ছড়িয়ে যায়।
চিকিৎসা
লিভার ক্যান্সারের নিরাময় খুবই কষ্টকর। প্রাইমারি লিভার ক্যান্সার আগেভাগে যদি ধরা যায় তাহলে হয়ত নিরাময় করা যাবে। সেকেন্ডারি বা মেটাস্টেটিক লিভার ক্যান্সারের চিকিৎসা করা কঠিন যেহেতু এটা ছড়িয়ে গিয়েছে। অধিকাংশ চিকিৎসায় রোগীদের যাতে ভালো লাগে ও বেশীদিন বাঁচে সেটাই দেখা হয়।
প্রাইমারি লিভার ক্যান্সারের চিকিৎসা সেই রোগ নির্ণয়ের ধাপ সহ রোগীর বয়সের ওপরেও নির্ভর করে।
সার্জারি
অপারেশান করে লিভার ক্যান্সারের চিকিৎসার মধ্যে আছেঃ
টিউমার বাদ দেবার সার্জারিঃ কোন কোন পরিস্থিতিতে, লিভার ক্যান্সার এবং লিভার ঠিকমতন কাজ করলে ও টিউমার ছোট আকারের হলে তার আশেপাশের সুস্থ টিস্যু বাদ দেবার জন্য অপারেশান করার পরামর্শ দিতে পারেন। রোগীর কোন বিকল্প আছে কিনা সেটা লিভারের মধ্যে ক্যান্সারের জায়গা, লিভার কতটা ভালোকরে কাজ করছে এবং রোগীর সার্বিক স্বাস্থ্যের ওপর নির্ভরশীল।
লিভার ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারিঃ লিভার ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারির সময়, আক্রান্ত লিভার বাদ দেওয়া হয় ও দাতার সুস্থ লিভারের দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা হয়। প্রাথমিক পর্যায়ের লিভার ক্যান্সারের খুবই সামান্য সংখ্যক লোকদের ক্ষেত্রেই এটা সম্ভব।
রেডিওথেরাপি
এই থেরাপি অনেক উপায়ে দেওয়া যায়, কিন্তু লিভারের রেডিয়েশান সহ্য করবার ক্ষমতা কম থাকার জন্য এর সীমাবদ্ধতা আছে। ব্যবহার যখন করা হয়, লিভারের বাইরে সমস্যা কমানোটা কিংবা টিউমারকে সঙ্কুচিত করে লিভারের ভেতরে যন্ত্রণা কমানোটাই হল রেডিয়েশানের ভুমিকা। রেডিও এমবলিজিম থেরাপি উপাদান ব্যবহার করে টিউমারকে রক্ত সরবরাহন বন্ধ করে দেওয়া হয়।
কেমোথেরাপি
কেমোএম্বোলাইজেশান এক ধরনের কেমোথেরাপি যা টিউমারের আকার কমিয়ে সার্জারির উপযুক্ত করার জন্য লিভারকে সরাসরি শক্তিশালী অ্যান্টি-ক্যান্সারাস ওষুধ সরবরাহ করে।
ক্যান্সার কোষকে গরম করা। রেডিও-ফ্রিকুয়েন্সি অ্যাবালেশান নামে পরিচিত এই পদ্ধতির সাহায্যে ক্যান্সার কোষকে গরম করে ধবংস করার জন্য ইলেকট্রিক কারেন্ট ব্যবহার করা হয়। তলপেটে ছোট্ট ছিদ্রের মধ্যে দিয়ে সার্জেন যাতে এক বা একাধিক পাতলা সূচ ঢোকাতে পারে তাই সিটি স্ক্যান অথবা আলট্রাসাউন্ড ব্যবহার করে পথনির্দেশ নেওয়া হয়। সূচ যখন টিউমার পর্যন্ত পৌঁছায়, ক্যান্সার কোষদের ধবংস করবার জন্য ইলেকট্রিক কারেন্ট দিয়ে গরম করা হয়।
ক্যান্সার কোষকে হিমায়িত করা। ক্রায়োব্লাশান নামক এই প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ ঠাণ্ডা ব্যবহার করে ক্যান্সার কোষকে ধবংস করা হয়। প্রক্রিয়ার সময়ে, ডাক্তার সরাসরি লিভার টিউমারের ওপর তরল নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ একটা যন্ত্র (ক্রায়োপ্রোব) রাখে। আলট্রাসাউন্ড ছবি ব্যবহার করে ক্রায়োপ্রোবকে নির্দেশ দেওয়া হয় এবং ক্যান্সার কোষ জমানো হয়।
Discussion about this post