মানব দেহের অতীব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল লিভার (যকৃত)। দেহকে সুস্থ্য ভাবে কার্যক্ষম রাখার জন্য এই লিভারকে অনেক কাজ করতে হয় যেমন খাদ্য হজম করতে, গ্লাইকোজেনের সঞ্চয়, প্লাজমা প্রোটিন সংশ্লেষণ, ঔষুধ বা অন্যান্য রাসায়নিক নির্বিষকরণ, পিত্তরস উৎপাদন, রক্ত পরিস্রুত করণ ইত্যাদি। উল্লেখিত কাজ ছাড়াও লিভার দেহের আরও কিছু জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। এক কথায় বলতে গেলে লিভার হলো মানব দেহের একটি পাওয়ার স্টেশন যার সুস্থতার উপর আমাদের দেহের অন্যান্য অনেক কিছুই নির্ভর করে।
লিভার সুস্থ্য রাখতে লিভারের জটিল রোগসমূহ সম্পর্কে আমাদের সবার সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন কারন লিভারের রোগের লক্ষণাদি সহসাই প্রকাশ পায় না এমন কি লিভারের এগারো ভাগের একভাগ অংশ ও যদি ভালো থাকে তবে সে অবস্থাতেও লিভারের রোগ প্রকাশিত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। তাই আমাদের খুব ভাল করে এর যত্ন, রোগ ও প্রতিরোধ সম্পর্কে সচেতন থাকা দরকার। তাই এর গুরুত্ব অনুধাবন করে আমাদের দেশে যে সব লিভারের জটিল রোগ হয়ে থাকে সেই সব রোগ এর লক্ষণ, প্রতিরোধে ও চিকিৎসায় করণীয় সম্পর্কে বর্ননা করা হলো।
ভাইরাল হেপাটাইটিস
হেপাটাইটিস হলো লিভারে প্রদাহ, সাধারনত হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি এবং ই ভাইরাস দ্ধারা স্বল্প মেয়াদী প্রদাহ কে ভাইরাল হেপাটাইটিস বলে। আমরা অনেকেই এই ধরনের রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেলে তাকে জন্ডিস বলি। দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে ‘এ’ এবং ‘ই’ ভাইরাস ছড়ায় এবং স্বল্প মেয়াদী লিভার প্রদাহ করে থাকে।
ভাইরাল হেপাটাইটিস এর লক্ষণ
একিউট ভাইরাল হেপাটাইটিস বা স্বল্পমেয়াদী লিভার প্রদাহের প্রধান লক্ষণগুলো হলো— জন্ডিস, খাবারে অরুচি, উপরের পেটের ডান দিকে বা মাঝখানে ব্যথা, বমি বমি ভাব ও বমি, দুর্বলতা ও জ্বর।
ভাইরাল হেপাটাইটিস হলে করণীয়
রোগীকে হলুদ, মরিচ, তরিতরকারি, মাছ-মাংস ইত্যাদি স্বাভাবিক খাবার খেতে দিন। ফল, ডাবের পানি, আখের রস ইত্যাদি খাওয়াবেন না। ঘন ঘন গোসল করাবেন না। ১ থেকে ২ সপ্তাহের মধ্যে যদি রোগের লক্ষণ ভালো না হয়, তবে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করবেন। রোগ ধরা পরার পর কেউ অস্থিরতা, অস্বাভাবিক আচরণ করলে বা অজ্ঞান হলে, এটা মারাত্মক জরুরি অবস্থা। তাকে অনতিবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
ক্রনিক হেপাটাইটিস
লিভারের দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহের ফলে যেসব রোগ হয়ে থাকে তাকে ক্রনিক হেপাটাইটিস বলে। হেপাটাইটিস বি, সি ও ডি ভাইরাস রক্ত কিংবা দূষিত সিরিঞ্জ বা সুচের মাধ্যমে ছড়ায়। তবে হেপাটাইটিস ই-ভাইরাস রক্তের মাধ্যমেও ছড়ায়। বাংলাদেশে ক্রনিক হেপাটাইটিসের প্রধান কারণ হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস। রোগী প্রাথমিক অবস্থায় বুঝতেই পারেন না কখন তিনি বি অথবা সি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। চিকিৎসাবিহীন থাকলে এই সংক্রমণ মাসের পর মাস লিভার এর ক্ষতি করে। এমনকি লিভার সিরোসিসে রূপ নেয় এবং পরে লিভার ক্যান্সারে রূপান্তরিত হতে পারে। উল্লেখ্য, হেপাটাইটিস ‘বি’ এবং ‘সি’ ভাইরাস আমাদের দেশে যথাক্রমে ৬০ ও ৩০ শতাংশ লিভার সিরোসিস এবং যথাক্রমে ৬৪ ও ১৭ শতাংশ হেপাটোসেলুলার কারসিনোমা বা লিভার ক্যান্সার এর জন্য দায়ী।
ক্রনিক হেপাটাইটিসের লক্ষণসমূহ
ক্রনিক ভাইরাল হেপাটাইটিস তথা দীর্ঘ মেয়াদী লিভার প্রদাহে ভাইরাস সুপ্ত অবস্থায় লিভারের কোষে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে। ফলে কোনো সুস্পষ্ট লক্ষণ পাওয়া যায় না। কারও কারও ক্ষেত্রে দুর্বলতা, ক্ষুধামন্দা ও পেটে হালকা ব্যথা অনুভূত হতে পারে। রোগের লক্ষণ দেখে পরীক্ষা ছাড়া বোঝার উপায় নেই কোন ভাইরাস হয়েছে। কিন্তু যাদের ক্রনিক ভাইরাল হেপাটাইটিস থেকে লিভার সিরোসিস হয়ে যায় তাদের ক্ষুধামন্দা, পেটের অসুখ, শরীর শুকিয়ে যাওয়া, জন্ডিস, পেটে পানি আসা ও চেতনালোপ জাতীয় লক্ষণ দেখা দেয়।
ক্রনিক হেপাটাইটিস হলে করণীয় ও চিকিৎসা
এমতাবস্থায় অনতিবিলম্বে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে পরিক্ষা করাতে হবে যে এই ভাইরাসের প্রাণ HBV DNA বা HBeAg রক্তে বহমান কিনা? এবং তা ছয় মাসের বেশি সময় ধরে পজেটিভ কিনা? ভাইরাসটা লিভারে সংক্রামিত হয়ে লিভারের ক্ষতি করে লিভার এনজায়েম ALT(SGPT) বাড়িয়ে দিয়েছে কিনা? যদি রোগীর রক্তে HBV DNA বা HBeAg ছয় মাসের বেশি সময় পরেও বিদ্যমান থাকে, রক্তে ALT (SGPT) দুই বা আড়াই গুণেরও বেশি থাকে তখন মানুষটি রোগী বলে বিবেচিত হবেন। কিন্তু ALT (SGPT) পরিমাণ যদি স্বাভাবিক থাকে, HBV DNA ও HBeAg নেগেটিভ থাকে তবে কিন্তু তিনি রোগী নন, HBsAg বহনকারী সুস্থ Carrier, তার চিকিৎসা অনাবশ্যক, তিনি এই রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাহীন এবং এর প্রতিষেধকও নিতে পারবেন না।
Discussion about this post