পরিবশে দূষণ থাকলে তা মনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মডেল: ছবি: সুমন ইউসুফনগরায়ণ, কর্মব্যস্ততা প্রভৃতি মানসিক বিষাদ বা বিষণ্নতার কারণ। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, নগরের পরিবেশদূষণও শারীরিক সমস্যা তৈরির পাশাপাশি বিষণ্নতাসহ নানা রকম মানসিক সমস্যা তৈরি করে।
লিখেছেন মনোরোগ চিকিৎসক আহমেদ হেলাল
২০১৯ সালে প্রকাশিত জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, দেশে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে বিষণ্নতার হার ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। শহরে বিষণ্নতার হার ৮ দশমিক ২ আর গ্রামে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) আরেকটি গবেষণায় রাজধানীর ৭১ শতাংশ মানুষ বিষণ্নতায় ভুগছে বলে জানানো হয়।
নগরায়ণ, কর্মব্যস্ততাসহ নানা কারণে শহরে বিষণ্নতার হার বেশি বলে গবেষকেরা একমত, কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় জানা গেছে, নগরীর বিষাক্ত বাতাসও হতে পারে বিষণ্নতার কারণ। বাংলাদেশে দূষিত বাতাসের সঙ্গে বিষণ্নতার সম্পর্ক নিয়ে তেমন কোনো বড় মাপের গবেষণা না হলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। সাধারণ ধারণা আছে যে দূষিত বাতাসের কারণে শ্বাসতন্ত্রের রোগ বেশি হয়, কিন্তু দূষণের সঙ্গে মানসিক সমস্যারও সম্পর্ক রয়েছে।
আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী এনভায়রনমেন্টাল হেলথ পারসপেক্টিভ–এর ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত ‘বায়ুদূষণের সঙ্গে বিষণ্নতা, রাগ, উদ্বেগ, খিটখিটে মেজাজ ও আত্মহত্যার সম্পর্ক’ শীর্ষক এক নিবন্ধে বিশ্বের ১৬টি দেশের ১৯৭৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বায়ুদূষণ–সংক্রান্ত তথ্য–উপাত্তের সঙ্গে ১৫ থেকে ৩৯ বছর বয়সী মানুষের বিষণ্নতার সম্পর্ক তুলনা করে গবেষকেরা জানান, দূষিত বায়ুতে শ্বাস–প্রশ্বাস নেওয়া মানুষেরা অন্যদের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি বিষণ্নতায় ভোগে। আর তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি।
ঢাকা শহরে বায়ুদূষণের মাত্রা অত্যন্ত বেশি। বায়ুদূষণের দিক থেকে ঢাকা কখনো প্রথম, আবার কখনো দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থানের নিচে মোটেই নামছে না। আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় ঢাকা ছিল ১ নম্বরে। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল নয়াদিল্লি। আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের তথ্য অনুযায়ী ঢাকার বাতাস পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে দূষিত। বাতাসের মানসূচকে (একিউআই) নভেম্বর ২০১৯–এ ঢাকার স্কোর ছিল ২৪২। এর অর্থ হলো, ঢাকায় বাতাসের মান খুবই অস্বাস্থ্যকর।
এই তালিকায় ঢাকার পরেই রয়েছে যথাক্রমে ভারতের দিল্লি, পাকিস্তানের লাহোর ও মঙ্গোলিয়ার উলানবাটর শহর। নভেম্বর ২০১৯–এ একিউআই সূচকে দিল্লির স্কোর ২১১ এবং লাহোর ও উলানবাটরের স্কোর ছিল ১৯৮। কেবল ঘরের বাইরে নয়, ঘরের ভেতরের বাতাসও দূষিত হয়ে যাচ্ছে। বাইরের দূষিত বাতাসের ৪২ শতাংশ দরজা, জানালা দিয়ে ঘরে চলে আসে। এর সঙ্গে ঘরের ধুলাবালু, ময়লা-আবর্জনা, ডিটারজেন্ট, রান্না ও টয়লেট থেকেও দূষিত পদার্থ ঘরের বাতাসে যুক্ত হয়।
এই ঘরে বাইরের দূষিত বাতাসের কারণে বাড়ছে বিষণ্নতা, মেজাজ হয়ে যাচ্ছে খিটখিটে আর বাড়ছে আত্মহত্যার ঝুঁকি।
কীভাবে দূষিত বাতাস বিষণ্ন করে তোলে
যুক্তরাজ্যের কিংস কলেজ ও ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনের গবেষণায় বলা হয়, দূষিত বাতাসে ভারী বস্তুকণা পিএম ২ দশমিক ৫ ও পিএম ১০–এর পরিমাণ বেড়ে গেলে তা সেগুলো অন্যান্য ভারী ধাতুর সঙ্গে মিশে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। এগুলো বাতাসের মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করলে মস্তিষ্কে অক্সিজেনের সরবরাহ কমে যায়। ফলে মানুষের মস্তিষ্কের আবেগ আর চিন্তার অংশগুলো ঠিকমতো কাজ করে না। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, কোনো কাজে মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। মানুষ বিষণ্ন হয়ে ওঠে। আত্মহত্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই বায়ুদূষণজনিত মানসিক স্বাস্থ্যহানিকে ‘নীরব জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা’ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক সভায় জানানো হয়, বায়ূদূষণ রোধ করে বিষণ্নতার হার ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনা যায়। সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত, দূষিত বাতাসে শ্বাস–প্রশ্বাস গ্রহণকারীদের মধ্যে বুদ্ধির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, ভবিষ্যতে তাদের মধ্যে ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। ডেনমার্ক ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করা পৃথক দুটি গবেষণায় দেখা যায়, বায়ুদূষণের কারণে আবেগজনিত মানসিক সমস্যা- বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডারের আধিক্য বেড়ে যায়। এতে করে উত্তেজিত হয়ে ওঠা, অতি চঞ্চলতা বেড়ে যায়। কেবল প্রাপ্তবয়স্করাই নন, শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে এই বায়ুদূষণ। শিশুদের জ্ঞানীয় বিকাশের (কগনিটিভ, বুদ্ধি, অনুভব) ঘাটতি হয়। এ ছাড়া যাদের মধ্যে আগে থেকেই মানসিক সমস্যা আর খিঁচুনি রোগ ছিল, তাদের সেই রোগের লক্ষণগুলো দূষিত বাতাসের কারণে বেড়ে যায়, খিঁচুনির মাত্রা বাড়তে থাকে।
সায়েন্স অব টোটাল এনভায়রনমেন্টের জানুয়ারি ২০২০ সংখ্যায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে ১০টি দেশের ওপর করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাতাসে নাইট্রিক অক্সাইডের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হলে বিষণ্নতার হার বেড়ে যায়।
বাতাসে দূষণ। কখনো বিষণ্নতা দেখা গেলে যেতে হবে চিকিৎসকের কাছে
করণীয় কী
মূলত একটি নগরীর বায়ূদূষণের জন্য ব্যক্তিপর্যায়ে সচেতনতার বিকল্প নেই। যেসব বিষয় বায়ুদূষণের জন্য দায়ী, সেগুলোর প্রতি সচেতনতা বাড়ানো আর তা থেকে নিজে দূরে থাকা এবং অপরকে দূরে রাখার চেষ্টা করা। নগরীর কাছাকাছি ধোঁয়া সৃষ্টি হয় এমন অবকাঠামো না থাকা, যেসব যানবাহন বাতাসকে দূষিত করে, সেগুলোর চলাচল বন্ধ রাখা, নগরীতে পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্রিন জোন রাখা, উদ্যান আর গাছপালার ব্যবস্থা থাকা। আর ব্যক্তিপর্যায়ে যে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে, তা হলো ঘরের ভেতরটা যাতে বাতাস চলাচলের উপযোগী থাকে, সেই ব্যবস্থা করা, বেশি করে গাছ লাগানো, বাতাসকে দূষিত করে এমন যেকোনো কাজ থেকে দূরে থাকা (কয়লা পোড়ানো, যানবাহনের নিয়মিত যত্ন নেওয়া, যাতে কালো ধোঁয়া তৈরি না হয়), সাধারণ মাস্কের বদলে বিশেষ ধরনের মাস্ক ব্যবহার করা, প্রয়োজন না থাকলে দূষিত বাতাসে বেশি না বেড়ানো।
আর দূষিত বাতাস বা যেকোনো কারণে যদি কারও মধ্যে বিষণ্নতার লক্ষণ (কমপক্ষে ২ সপ্তাহ ধরে মন খারাপ, কোনো কাজে উৎসাহ না পাওয়া, খিটখিটে মেজাজ, ভুলে যাওয়া, কান্না পাওয়া, আত্মহত্যার প্রবণতা, শরীরে ব্যথাসহ নানা উপসর্গ) দেখা দেয়, তবে সেটিকে হেলা না করে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়াটা জরুরি।
কী ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে
দূষিত বাতাসের কারণে কেবল বিষণ্নতা নয়, আরও নানা ধরনের মানসিক লক্ষণ দেখা দিতে পারে। যেমন:
● মাথাব্যথা
● ভুলে যাওয়া
● মনোযোগ কমে যাওয়া
● অস্থিরতা
● তুচ্ছ কারণে রেগে যাওয়া
● মন খারাপ করা, কাজকর্মে উৎসাহ না পাওয়া
● ঘন ঘন মুড চেঞ্জ হওয়া
● বিষণ্নতা
● উদ্বিগ্নতা
● মৃত্যুর ইচ্ছা বা আত্মহত্যার প্রবণতা
আহমেদ হেলাল
সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।
Discussion about this post